- মতামত
- মানিক ভাইয়ের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোতে
স্মৃতিচারণ
মানিক ভাইয়ের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোতে

কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী, আমাদের মানিক ভাই। তিনি ছিলেন একাধারে বীর মুক্তিযোদ্ধা, ভাষাসংগ্রামী ও রাজনীতিবিদ। বৃহত্তর সিলেটে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় বিশেষ ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধে তার বীরোচিত ভূমিকার কারণেই তিনি কমান্ড্যান্ট উপাধিতে ভূষিত হন। তার নেতৃত্বের কথা আমার আজও মনে পড়ে। তিনি স্কুলজীবনে যে নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছেন, সেই নেতৃত্ব পরবর্তী জীবনে তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে।
মনে পড়ে, বানিয়াচংয়ে ম্যালেরিয়া মহামারির সময় মানিক ভাই ছাত্র ছিলেন। তখন তিনি বানিয়াচং গেলেন অনেককে সঙ্গে করে। তন্মধ্যে তার সহপাঠীরাও ছিলেন। কীভাবে এই মহামারি থেকে রক্ষা পাওয়া যায় তার সুপরামর্শ দেন। মানিক ভাই বিভিন্ন গ্রামে সভা-সমাবেশ করেছেন। তিনি নাটকও করতেন। ছাত্রদের কল্যাণে অর্থ তোলার জন্য নাটক করতেন; নাটক বানাতেন।
ভাষা আন্দোলনের সময় মানিক ভাইসহ আমরা বৃন্দাবন কলেজের ছাত্র ছিলাম। তখন মিছিল-মিটিংয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন মানিক ভাই। আমরা তখন ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। বৃন্দাবন কলেজের সব অনুষ্ঠান তিনিই করেছেন। একবার হবিগঞ্জে সংস্কৃতিমন্ত্রী মফিজুল ইসলাম এলে আমরা কালো পতাকা দেখিয়েছিলাম। খুব বড় মিছিল হয়েছিল। সেদিন মানিক ভাই ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। তখন কোনো মন্ত্রীকে কালো পতাকা দেখানো ছিল অনেক সাহসের ব্যাপার। এ ঘটনায় মানিক ভাইকে গ্রেপ্তার করলে হবিগঞ্জে অনেক উত্তেজনা হয়।
আমরা হবিগঞ্জে সব সময় ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করেছি। সে সময় অনেকে ধর্মের ধুয়া তুলতেন। কিন্তু আমরা মানুষকে সঠিক বিষয়টি বোঝালে তাদের মনোভাব পুরোপুরি বদলে যায়। আমরা বুঝিয়েছি, যেখানকার মানুষ দ্বারা দেশ সৃষ্টি সেই, সে দেশের ভাষাই রাষ্ট্রভাষা হয়। এমনকি আরবের মতো দেশেও তাদের আরবিতে রাষ্ট্রভাষা করে দেওয়া হয়েছে। এগুলো তখন মানুষ খুব গ্রহণ করেছিল।
আমরা বিভিন্ন স্কুলে সপ্তাহ সপ্তাহ করে যেতাম। হবিগঞ্জ থেকে ছাত্র নিলে তারা মনে করত, ছাত্রদের লিডাররা আসছেন। তখন ছেলেরা খুব সাহায্য করেছে। শায়েস্তাগঞ্জ হাই স্কুলে আমাদের একজন শিক্ষক ছিলেন, তার নামটা ঠিক মনে পড়ছে না; তিনি আমাদের সাহায্য করেছিলেন। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত; আমাদের বাঁচতে হলে এই ভাষা দরকার। ভাষা আন্দোলনের সভা-সমাবেশ গভর্নমেন্ট স্কুল মাঠে করতাম। সে স্কুলে একটি মুসলিম হোস্টেল ছিল। তার সামনে খালি জায়গায় আমরা সভা করতাম। আর বৃন্দাবন কলেজ মাঠে মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশ করা হতো। তখন আফছার আহমদ, মুসলিম কোয়ার্টারের মাহবুবুল বারী ঢাকা থেকে আসতেন। এমন অনেকে রয়েছেন।
মানিক ভাইয়ের আর্থিক কিছু সমস্যা থাকলেও কখনও মন খারাপ করেননি। ছাত্রজীবনের আন্দোলন থেকে যে শিক্ষা পেয়েছিলেন, তা অনুসরণ করেই তিনি চলতেন। ১৯৬৯-এ একবার হবিগঞ্জে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন। চিলড্রেন পার্কে (মুসলিম কোয়ার্টার) একটি সভা হয়েছিল। মানিক ভাই ওই সভা পরিচালনা করেন।
১৯৭১ সালে হবিগঞ্জে মানিক ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি। একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণের পর হবিগঞ্জ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব মানিক ভাইয়ের হাতেই ছিল। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মানিক ভাই দেখা করার পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- মানিক, তুমি যাও। তোমার এলাকায় গিয়ে জনগণকে সুসংগঠিত করো। ২৫ মার্চ মানিক ভাইয়ের অনেক ভূমিকা ছিল। তখন যদি মানিক ভাই পিছিয়ে যেতেন, তাহলে আন্দোলনই ব্যর্থ হয়ে যেত। হবিগঞ্জে যখন মানিক ভাইকে স্বাধীনতার বার্তা পাঠানো হয়েছিল; সে সময় এক উত্তাল পরিবেশ ছিল। তখন আমাদের কাছে তেমন অর্থ ছিল না। মানিক ভাই ট্রেজারি থেকে আমাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে দেন। শেরপুর-সাদিপুর যুদ্ধ মানিক ভাইয়ের নেতৃত্বে হয়। একাত্তরের যুদ্ধে আমাকে এবং আমার ভাইকে অনেক নির্যাতন করা হয়। তখন কিছু লোক ছিল; তারা রাজনীতির প্রতিহিংসা মিটিয়েছে। অনেক নির্যাতন করেছিল আমাকে রাস্তার মাঝে ফেলে। কাপড়-চোপড় খুলে রাইফেল দিয়ে অনেক মারধর করেছিল। আরেক লোকের কথা আমার মনে পড়ছে; আমার তালই চুনারুঘাটের মকসুদ মিয়া। তার ওপর অনেক অত্যাচার করা হয়েছিল। আমরা তখন খুব কেঁদেছিলাম।
মানিক চৌধুরী ছিলেন আন্দোলনমুখী মানুষ। তার মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জে নেতৃত্ব দেওয়া সহজ হয়। দেশপ্রেমের কারণে তিনি সমরে ও শান্তিতে ছিলেন অগ্রসৈনিক। সমরে তার লড়াই ছিল দেশকে মুক্ত করার। স্বাধীনতার পর তার সমর ছিল দেশ গড়ার। তিনি ৬ দফা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণসহ তৎকালীন সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে হবিগঞ্জ থেকে এমএনএ এবং ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গ্রার্থী হিসেবে তৎকালীন সিলেট-১৮ আসন থেকে নির্বাচিত হন।
শ্যামল প্রকল্পের জন্য তিনি ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে 'বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক' গ্রহণ করেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্ব্বরূপ তাকে ২০১৫ সালে 'মরণোত্তর' স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। ফেব্রুয়ারির এই ভাষার মাসে আমরা মানিক ভাইকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
চৌধুরী আব্দুল হাই: ভাষাসংগ্রামী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও হবিগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য
মনে পড়ে, বানিয়াচংয়ে ম্যালেরিয়া মহামারির সময় মানিক ভাই ছাত্র ছিলেন। তখন তিনি বানিয়াচং গেলেন অনেককে সঙ্গে করে। তন্মধ্যে তার সহপাঠীরাও ছিলেন। কীভাবে এই মহামারি থেকে রক্ষা পাওয়া যায় তার সুপরামর্শ দেন। মানিক ভাই বিভিন্ন গ্রামে সভা-সমাবেশ করেছেন। তিনি নাটকও করতেন। ছাত্রদের কল্যাণে অর্থ তোলার জন্য নাটক করতেন; নাটক বানাতেন।
ভাষা আন্দোলনের সময় মানিক ভাইসহ আমরা বৃন্দাবন কলেজের ছাত্র ছিলাম। তখন মিছিল-মিটিংয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন মানিক ভাই। আমরা তখন ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। বৃন্দাবন কলেজের সব অনুষ্ঠান তিনিই করেছেন। একবার হবিগঞ্জে সংস্কৃতিমন্ত্রী মফিজুল ইসলাম এলে আমরা কালো পতাকা দেখিয়েছিলাম। খুব বড় মিছিল হয়েছিল। সেদিন মানিক ভাই ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। তখন কোনো মন্ত্রীকে কালো পতাকা দেখানো ছিল অনেক সাহসের ব্যাপার। এ ঘটনায় মানিক ভাইকে গ্রেপ্তার করলে হবিগঞ্জে অনেক উত্তেজনা হয়।
আমরা হবিগঞ্জে সব সময় ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করেছি। সে সময় অনেকে ধর্মের ধুয়া তুলতেন। কিন্তু আমরা মানুষকে সঠিক বিষয়টি বোঝালে তাদের মনোভাব পুরোপুরি বদলে যায়। আমরা বুঝিয়েছি, যেখানকার মানুষ দ্বারা দেশ সৃষ্টি সেই, সে দেশের ভাষাই রাষ্ট্রভাষা হয়। এমনকি আরবের মতো দেশেও তাদের আরবিতে রাষ্ট্রভাষা করে দেওয়া হয়েছে। এগুলো তখন মানুষ খুব গ্রহণ করেছিল।
আমরা বিভিন্ন স্কুলে সপ্তাহ সপ্তাহ করে যেতাম। হবিগঞ্জ থেকে ছাত্র নিলে তারা মনে করত, ছাত্রদের লিডাররা আসছেন। তখন ছেলেরা খুব সাহায্য করেছে। শায়েস্তাগঞ্জ হাই স্কুলে আমাদের একজন শিক্ষক ছিলেন, তার নামটা ঠিক মনে পড়ছে না; তিনি আমাদের সাহায্য করেছিলেন। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত; আমাদের বাঁচতে হলে এই ভাষা দরকার। ভাষা আন্দোলনের সভা-সমাবেশ গভর্নমেন্ট স্কুল মাঠে করতাম। সে স্কুলে একটি মুসলিম হোস্টেল ছিল। তার সামনে খালি জায়গায় আমরা সভা করতাম। আর বৃন্দাবন কলেজ মাঠে মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশ করা হতো। তখন আফছার আহমদ, মুসলিম কোয়ার্টারের মাহবুবুল বারী ঢাকা থেকে আসতেন। এমন অনেকে রয়েছেন।
মানিক ভাইয়ের আর্থিক কিছু সমস্যা থাকলেও কখনও মন খারাপ করেননি। ছাত্রজীবনের আন্দোলন থেকে যে শিক্ষা পেয়েছিলেন, তা অনুসরণ করেই তিনি চলতেন। ১৯৬৯-এ একবার হবিগঞ্জে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন। চিলড্রেন পার্কে (মুসলিম কোয়ার্টার) একটি সভা হয়েছিল। মানিক ভাই ওই সভা পরিচালনা করেন।
১৯৭১ সালে হবিগঞ্জে মানিক ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি। একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণের পর হবিগঞ্জ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব মানিক ভাইয়ের হাতেই ছিল। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মানিক ভাই দেখা করার পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- মানিক, তুমি যাও। তোমার এলাকায় গিয়ে জনগণকে সুসংগঠিত করো। ২৫ মার্চ মানিক ভাইয়ের অনেক ভূমিকা ছিল। তখন যদি মানিক ভাই পিছিয়ে যেতেন, তাহলে আন্দোলনই ব্যর্থ হয়ে যেত। হবিগঞ্জে যখন মানিক ভাইকে স্বাধীনতার বার্তা পাঠানো হয়েছিল; সে সময় এক উত্তাল পরিবেশ ছিল। তখন আমাদের কাছে তেমন অর্থ ছিল না। মানিক ভাই ট্রেজারি থেকে আমাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে দেন। শেরপুর-সাদিপুর যুদ্ধ মানিক ভাইয়ের নেতৃত্বে হয়। একাত্তরের যুদ্ধে আমাকে এবং আমার ভাইকে অনেক নির্যাতন করা হয়। তখন কিছু লোক ছিল; তারা রাজনীতির প্রতিহিংসা মিটিয়েছে। অনেক নির্যাতন করেছিল আমাকে রাস্তার মাঝে ফেলে। কাপড়-চোপড় খুলে রাইফেল দিয়ে অনেক মারধর করেছিল। আরেক লোকের কথা আমার মনে পড়ছে; আমার তালই চুনারুঘাটের মকসুদ মিয়া। তার ওপর অনেক অত্যাচার করা হয়েছিল। আমরা তখন খুব কেঁদেছিলাম।
মানিক চৌধুরী ছিলেন আন্দোলনমুখী মানুষ। তার মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জে নেতৃত্ব দেওয়া সহজ হয়। দেশপ্রেমের কারণে তিনি সমরে ও শান্তিতে ছিলেন অগ্রসৈনিক। সমরে তার লড়াই ছিল দেশকে মুক্ত করার। স্বাধীনতার পর তার সমর ছিল দেশ গড়ার। তিনি ৬ দফা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণসহ তৎকালীন সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে হবিগঞ্জ থেকে এমএনএ এবং ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গ্রার্থী হিসেবে তৎকালীন সিলেট-১৮ আসন থেকে নির্বাচিত হন।
শ্যামল প্রকল্পের জন্য তিনি ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে 'বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক' গ্রহণ করেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্ব্বরূপ তাকে ২০১৫ সালে 'মরণোত্তর' স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। ফেব্রুয়ারির এই ভাষার মাসে আমরা মানিক ভাইকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
চৌধুরী আব্দুল হাই: ভাষাসংগ্রামী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও হবিগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য
মন্তব্য করুন