
আবার ফিরে এলো একুশের বইমেলা। এই করোনা আক্রান্ত পৃথিবীতে অন্য অনেক কিছুর মতো সারা দুনিয়াতেই বন্ধ ছিল বইমেলা। আমাদের দেশে গত বছরে ২০২১ মার্চের শেষে শুরু হওয়া বইমেলা ছিল নিষ্প্রাণ। এবার যে বইমেলাটা শুরু হলো- এটা একটা আশাবাদের জায়গা। গত দুই বছরে বাংলাদেশের যে শিল্প সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তা হচ্ছে প্রকাশনা শিল্প। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় এ খাতের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। প্রকাশকরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন এবারের বইমেলায়! আমার মনে হয় সেই সম্ভাবনা আছে। মানুষ আসলে এক প্রকার ঘরে বন্দি ছিল। গত দুই বছর বইমেলায় সে রকম পাঠক-ক্রেতা না থাকায় এ বছর সবাই পরিবার নিয়ে বইমেলায় আসবেন এবং কিনবেন তাদের পছন্দের বইগুলো। সরকারকে ভাবতে হবে কীভাবে এই মেলার প্রকাশকদের প্রণোদনা দেওয়া যায়। কারণ প্রকাশকরা গত দুই বছরে সত্যি সত্যি বড় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বইমেলায় স্টল ভাড়া কম নেওয়ার কথা চলছে, এটা হলে ভালো। সবচেয়ে ভালো হয়, এক বছর স্টলের ভাড়া না নিলে। বাংলাদেশে গত ৫০ বছরের ইতিহাসের সাংস্কৃতিক লড়াই সংগ্রামের নাম হচ্ছে- আমাদের এই একুশের বইমেলা। মাসব্যাপী এই বইমেলার কারণে এখানে মৌলবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর যে নতুন চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির জাগরণ হয় আমরা বলতে পারি- তার পুরোটাতে এই বইমেলার প্রভাব ছিল, এখনও কিছুটা আছে।
গত ১০ বছরে আমাদের প্রাণের এই বইমেলার রং বেড়েছে। কিন্তু কতটা ভালো বই প্রকাশিত হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। বইমেলার রং বেড়েছে মানে এখানে শত শত প্রকাশক হয়েছেন। প্রতি বছর ৪-৫ হাজার নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে এই বইমেলাতে। কিন্তু আমরা এ বইমেলা শেষে কতগুলো বইয়ের কথা মনে করতে পারি এবং কতগুলো বই আসলে আলোচনার যোগ্য অথবা পাঠযোগ্য? বইমেলার এই রং বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমরা হারিয়েছি আমাদের সত্যিকারের প্রাণের বইমেলা! এই বইমেলাতে খুন হয়েছেন লেখক অভিজিৎ রায়। এ বইমেলা থেকে বই প্রকাশনার দায়ে কোমরে দড়ি বেঁধে গ্রেপ্তার করা হয়েছে লেখক-প্রকাশককে। পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বইয়ের টেক্সট নির্বাচনে। কোন বই মেলায় থাকবে কি থাকবে না, প্রতি বছর তা ঠিক করে দেওয়ার কথা বলে আসলে লেখক-প্রকাশকদের এক ধরনের ভয় দেখানো হচ্ছে। যে তুমি আসলে কী লিখবে, কী প্রকাশ করবে! যে বইমেলা মৌলবাদ সাম্প্রদায়ীকরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল, সেই বইমেলায় নানা নামে ঢুকে পড়েছে মৌলবাদী প্রতিষ্ঠানও। আমরা দেখছি বইমেলা শেষে কোনো কোনো বই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দিয়েছিল; বইমেলায় আলো ছড়িয়েছেন যারা, সেই লেখকদের মধ্যে দেশের একজনও প্রতিষ্ঠিত প্রগতিশীল-সৃজনশীল-মননশীল লেখক নেই! রংচঙে ওই বইমেলায় আমাদের ছন্দপতন হয়েছে। বইয়ের চেয়ে আমরা মনোযোগ দিয়েছি বাহারি প্যাভিলিয়ন ও স্টল নির্মাণে। বইমেলার সংবাদ থেকে হারিয়ে গেছে সৃজনশীল বইয়ের তালিকা। বলা হচ্ছে, এ বছর সবচেয়ে ইংরেজি শেখার বই বিক্রি হয়েছে। সে তো সারা বছরই বিক্রি হয়। মানুষজন দেশ ছাড়তে চান। ভদ্রলোক হতে চান আর একুশের বইমেলাতেই কেনেন সবচেয়ে বেশি ইংরেজি শেখার বই। বইমেলার এই বিশাল আয়োজন দেখলে মনে হবে এ দেশে গরিব প্রকাশক যেমন নেই, তেমন নেই গরিব লেখকও। আর পাঠকের কথা ভাবছেন! বইমেলার ভিড় দেখে মনে হবে তারও অভাব আমাদের নেই! কিন্তু এ দেশে বই লিখে আপনি যেমন জীবনযাপন করতে পারবেন না, তেমনি শুধু বই প্রকাশ করেও প্রকাশক হিসেবে টিকে থাকতে পারবেন না। উভয়কেই আলাদাভাবে তাই অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করতে হয়। গোটা সমাজে যখন বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা নেই, তখন আমরা হঠাৎ ১১ মাস শেষে কীভাবে আশা করব আমাদের অন্তত শ'খানেক ভালো সৃজনশীল-মননশীল বই এই মেলায় উপহার দেবে! আমি প্রকাশক হয়ে বসে থাকি একটি ভালো পাণ্ডুলিপির আশায়। পাঠকও হয়তো বসে আছেন এই বইমেলা থেকে একটি ভালো বইয়ের আশায়।
বাংলা একাডেমির এই একুশে বইমেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগটা বন্ধ করতে হবে! যেহেতু আমাদের ভালোমানের বইয়ের সংখ্যা কম, তাই প্যাভিলিয়ন নামে অহেতুক বিরাট অংশের জায়গা বরাদ্দ দেওয়া বন্ধ করা প্রয়োজন। কারণ পুরো বইমেলাটা হেঁটে শেষ করা সম্ভব নয় এক দিনে। বইমেলাকে কয়েক সারিতে নিয়ে আসা সম্ভব। তখন পাঠক একেবারে সব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখতে পারবেন এবং বই বিক্রিও বাড়বে বলে আমার বিশ্বাস।
এই বইমেলায় আপনি কীভাবে আসবেন? এর চারপাশের রাস্তায় যানজট থাকবে। এখানে গাড়ি রাখবেন কোথায়? যে তরুণ বাইসাইকেল নিয়ে আসবেন, সেটি রাখবেন কোথায়? যে মোটরসাইকেল নিয়ে আসবেন তিনিইবা কোথায় রাখবেন এই সাইকেল? ঢাকা শহরে বইমেলাকে কেন্দ্র করে ৫০টি দোতলা বাস চালু করা গেলে বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ পরিবার নিয়ে বইমেলায় আসতে পারতেন। সে রকম কোনো ব্যবস্থা না করে এই বিরাট বইমেলা আয়োজন শেষ পর্যন্ত পাঠক-প্রকাশকদের জন্য এক ভোগান্তির শিকার বলে আমার মনে হয়। বইমেলায় আয়োজক, সরকার ও প্রকাশকদের মনে রাখতে হবে, ৩০ বছর আগের ঢাকা শহর আর এখনকার রাস্তাঘাট আর সমাজটাই এখন নেই। এখন মানুষজন ঘরে বসেই অনলাইনে তার প্রিয় বইটি সম্পর্কে জানতে পারেন এবং কিনতে পারেন। ডিজিটাল এই দুনিয়ায় বইমেলাতে পাঠক-ক্রেতা আনার জন্য প্রকাশক নানা ধরনের আয়োজন করেন। আমি মনে করি, সেসব না করে একটা বিশাল উদ্যানকে আমরা রঙের বইমেলায় পরিণত করতে পারব কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও সৃজনশীলতার পথে আনতে পারব না। মূল কথা হচ্ছে, পাঠক-ক্রেতার সংখ্যা বইমেলায় বাড়াতে না পারলে এ আয়োজন পুরোটাই পণ্ডশ্রম। সরকার এবং আয়োজক প্রতিষ্ঠানকে ভাবতে হবে এখন নতুন সময়, নতুন বাস্তবতার কথা। ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে যানজট মুক্ত হয়ে আসলে কত পাঠক-ক্রেতা এই বইমেলা পর্যন্ত প্রতিদিনই আসতে পারবেন। আর আমাদের এই বইমেলায় পারিবারিক সংযুক্তি অনেক কমেছে গত ২০ বছরে। এখানে লেখক মানে কয়েকজন বড়দের লেখক। শিশু-কিশোরদের বই নিয়ে কথা নেই, আলোচনা নেই; নেই সেসব বই নিয়ে প্রচার-প্রচারণা। ফলে পরিবারের সবার জন্য আর একুশে বইমেলা নেই। শিশু-কিশোর-তরুণদের বইমেলায় আগ্রহী করতে না পারলে আগামীতে এই বইমেলা তার জৌলুস হারাবে।
আমাদের প্রয়োজন একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা। এক সপ্তাহের আন্তর্জাতিক এই বইমেলায় দেশের পাঠকরা দেশি-বিদেশি নানা ধরনের বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হতে পারতেন। তরুণদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জন্য এখন এই সময়ে আন্তর্জাতিক বইমেলার বিকল্প নেই। বাংলাদেশের প্রকাশক সমিতিগুলোর ব্যর্থতা এই যে, তারা দেশে কোনো ধরনের বইমেলার আয়োজন করতে পারে না। তবে তারা দলবেঁধে অন্য দেশের বইমেলা করতে যায়। সরকার আবার তাদের সাহায্য করে। সারা দুনিয়ায় প্রকাশকরা বইমেলার আয়োজন করেন; সরকার শুধু সহযোগিতা করে। বাংলাদেশে উল্টোটা হয়, এখানে সরকার বইমেলা আয়োজন করে। প্রকাশকরা সেখানে ঘর বেঁধে বসে পড়ে আর উঠতেও চায় না। সারা বছর এসব প্রকাশক সমিতির বই বিপণন নতুন পাঠক তৈরিতে কোনো ভূমিকা থাকে না। তারা শুধু চান সরকার তাদের কাছ থেকে বস্তা ভরে বই কিনে গোডাউনে ভরে রাখুক। পাঠক তৈরি না হওয়ার পেছনে এ দেশের প্রকাশকদের এই সময় আসলে কোনো ভূমিকা নেই। আমাদের ভালোমানের লেখক ও পাঠক তৈরির জন্য এখন বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলার আয়োজন দরকার।
ঢাকা আন্তর্জাতিক বঙ্গবন্ধু বইমেলা নাম দিয়ে আমরাই শুরু করতে পারি প্রতি বছর এ বইমেলা। একটি মাত্র বইমেলাকে কেন্দ্র করে বসে থাকলে আমাদের আর বই প্রকাশনা, লেখালেখি ও চিন্তার অগ্রসর হবে না। চাই বিষয়ভিত্তিক আরও আরও বইমেলা।
রবীন আহসান: কবি ও প্রকাশক
মন্তব্য করুন