উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সব শিক্ষার্থীকে আমরা অভিনন্দন জানাই। পাসের হার, সর্বোচ্চ জিপিএ এবং শতভাগ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ প্রতিষ্ঠান সংখ্যা তথা ফলের সব সূচকে এবার ইতিবাচক যে রেকর্ড হয়েছে, তার পেছনে 'সংক্ষিপ্ত সিলেবাস' নিঃসন্দেহে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। বস্তুত করোনা-দুর্যোগের কারণে এবার পরীক্ষাও হয়েছে তিন বিষয়ে। নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রম না হলেও করোনা সংকটের মধ্যেও প্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষার্থীরা যে চমকপ্রদ ফল এনেছে, তার অবদান বহুলাংশে তাদেরই। এই ফলের বিশেষ দিক এটাই যে, করোনার কারণে যেখানে ২০২০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় সবাই 'অটোপাসে' স্বয়ংক্রিয়ভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে, এবার সেখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় সশরীরে অংশ নিয়েছে। আমাদের মনে আছে, এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা ২০২০ সালে যখন দ্বিতীয় বর্ষে উন্নীত হন, তার আগেই দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হয়। ২০২১ সালের সংশোধিত ও পুনর্বিন্যাস করা পাঠ্যসূচিতে গ্রুপভিত্তিক তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে ছয়টি পত্রে পরীক্ষা হয়। অবশিষ্ট বিষয়গুলো পূর্বের জেএসসি ও এসএসসির ফলের আলোকে নির্ধারণ করা হয়।
আমরা মনে করি, উচ্চ মাধ্যমিকের এবারের ফল কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থীর মনোবেদনার কারণ হলেও অধিকাংশের মুখেই হাসি ফুটিয়েছে। তবে যারা সংক্ষুব্ধ হয়ে ফল পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করবে, তাদের বিষয়টি অন্যান্যবারের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সমকালের প্রতিবেদন অনুসারে গতকাল ফল প্রকাশের দিন থেকেই শিক্ষার্থীরা পুনর্নিরীক্ষার আবেদন করতে পারছে। আমরা দেখেছি, এর আগে ৩০ ডিসেম্বর প্রকাশিত এমন সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে অনুষ্ঠিত হওয়া এসএসসির রেজাল্টেও পুনর্নিরীক্ষায় উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থীর
ফল পরিবর্তন হয়; সেখানে পুনর্নিরীক্ষণে ফেল করা শিক্ষার্থীর জিপিএ ৫ পাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
উচ্চ মাধ্যমিকের পরই শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশ করবে। আমরা চাই, উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার পথ মসৃণ হোক। ইতোমধ্যে শিক্ষামন্ত্রী
সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা মনে করি, উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে একাডেমিক বিষয়ের সিলেবাস সংক্ষিপ্ত হলেও সাধারণ জ্ঞানের বিষয়গুলো আগের মতোই থাকা উচিত।
আমরা জানি, করোনার কারণে বাল্যবিয়ে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তারপরও স্বস্তির খবর হলো, উচ্চ মাধ্যমিকে শুধু অংশগ্রহণেই নয়, ফলেও ছাত্রীরা এগিয়ে রয়েছে। কয়েক বছর ধরেই ছাত্রীদের এগিয়ে থাকার ইতিবাচক ধারা আমরা দেখে আসছি। এবার যারা উত্তীর্ণ হয়েছে সেখানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছাত্রীরও বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যেতে পারে। আমরা প্রত্যাশা করি, বিবাহিত ছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিতে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসবে। বিশেষ করে, পরিবারের সহায়তা পেলে সংসার সামলেও যে শিক্ষা নিশ্চিত করে উন্নত 'ক্যারিয়ার' গড়া যায়, সে উদাহরণ সমাজে কম নেই।
সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এবং তিন বিষয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের অন্যান্য বিষয়ে দুর্বলতা থাকা অস্বাভাবিক নয়। উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ে এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে এসব শিক্ষার্থীর জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। যে সংকটময় পরিস্থিতিতে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস প্রণয়ন করা হয়েছে, সে পরিস্থিতি এখন নেই বললেই চলে। তাই এ বিষয়টি এ বছরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। অর্থাৎ উচ্চ মাধ্যমিকসহ এর পরের সব পরীক্ষা নিয়মিত সিলেবাসেই হওয়া জরুরি। একই সঙ্গে এরপর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাও সাধারণ নিয়মেই হওয়া প্রয়োজন। যেহেতু অধিকাংশ শিক্ষার্থীর টিকা নিশ্চিত হয়েছে এবং করোনার বিধ্বংসী প্রভাবও কমে এসেছে সেহেতু এ অজুহাতে শিক্ষার আর কোনো ধরনের ক্ষতি মেনে নেওয়া যায় না।
প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, এত ভালো ফলের পরও পাঁচ শতাংশ শিক্ষার্থী কেন ফেল করছে? কিংবা শতভাগ অকৃতকার্য হওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাই-বা শূন্যে আসছে না কেন? আমরা এর আগেও বলেছি, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক তথা সবার প্রচেষ্টা থাকলেও শতভাগ শিক্ষার্থী কৃতকার্য হওয়া অসম্ভব নয়। বলাবাহুল্য, এবারের ফলও আমাদের সে ইঙ্গিতই দিচ্ছে। করোনার মধ্যেও যদি শিক্ষার্থীরা বড় সাফল্য এনে দিতে পারে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে সময় লাগবে না। তবে শিক্ষার মানের যে প্রশ্ন রয়ে গেছে, সেখানেও জোর দেওয়া চাই।