চলমান ইউক্রেন সংকট অনেক প্রশ্নই সামনে নিয়ে এসেছে। প্রথমত প্রশ্ন দাঁড়ায়, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় এর বিরূপ প্রভাব কতটা দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যকার বিরোধ কোনদিকে যায় তার ওপর। এরই মধ্যে সমঝোতার লক্ষ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। যুদ্ধাক্রান্ত দেশ থেকে যাতে শরণার্থীরা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে পারেন, এর একটা ব্যবস্থা হলেও এ পথটা একেবারে নিস্কণ্টক হয়নি। তারপরও এ অবস্থায় ধারণা করা যায়, দু'পক্ষই বুঝতে পারছে- আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসা দরকার। রাশিয়া আরও বড় আকারে কিংবা শক্তি প্রয়োগ করে চূড়ান্ত অবস্থার দিকে যাচ্ছে না। এই যুদ্ধে হতাহতের চিত্র মর্মন্তুদ। একই সঙ্গে এও সত্য, এখন পর্যন্ত সেখানে যত মানুষ মারা গেছে, তার সংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কভিড ১৯-এ যত মানুষ মারা যাচ্ছে, তার চেয়ে কম। কথাটা এ জন্য বললাম, তাতে বোঝা যাচ্ছে, ধীরগতিতে আক্রমণ অব্যাহত রেখে রাশিয়া ইউক্রেনকে করায়ত্ত করতে চাচ্ছে।
ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার ভৌগোলিকভাবে বিভক্তিকরণের ঘটনা দূরের ইতিহাস নয়। উভয় দেশের মানুষের জীবনযাপন, সংস্কৃতিসহ নানা ক্ষেত্রে অনেক মিল রয়েছে। ইউক্রেনে এখনও যে রুশ জনগোষ্ঠী রয়েছে, সংখ্যার আনুপাতিক হারে তা কম নয়। যদিও তারা ইউক্রেনে সংখ্যালঘু, কিন্তু তাদের অস্তিত্ব তো শিকড়গাঁথা। আজ বিশ্ব গণমাধ্যম হয়তো ইউক্রেনে অবস্থিত এই সংখ্যালঘুদের নিয়ে তেমন কোনো বক্তব্য উপস্থাপন করছে না, কিন্তু তাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যাবে না। তাদের নিয়ে কথা না বলার বিষয়টি আমার কাছে অবাক কাণ্ড মনে হয়েছে।
কারণ বর্তমান বিশ্বে সংখ্যালঘুর অধিকারের বিষয়টি বহুল আলোচিত। ইউক্রেনে সেই সংখ্যালঘুর হার প্রায় ২৫ শতাংশ। যে জটিলতা নানা কারণে সৃষ্টি হয়েছে, এর প্রেক্ষাপটও আলোচনার বিষয়।
রাশিয়া ও ইউক্রেন পরিস্থিতি যে রূপ নিয়েছে, এ অবস্থায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট কত তাড়াতাড়ি বিদ্যমান সমস্যা সংকট সমাধানে এগোতে পারেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়। একটা কথা মনে রাখা দরকার, মানুষ বন্ধু বা শত্রুকে পরিত্যাগ করতে পারে, কিন্তু প্রতিবেশীকে পরিত্যাগ করা সম্ভব নয়। এর পেছনে নানা কারণের মধ্যে ভৌগোলিক কারণটি মুখ্য। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট চান বা না চান; রাশিয়ার প্রতিবেশী হয়েই তো থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেনেরই গভীরভাবে ভেবেচিন্তে সমঝোতার পথে হাঁটার দায়টা বেশি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট যেসব দাবি করছেন, তার সঙ্গে আছে ন্যাটোর সদস্যপদ লাভ কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে চাওয়া ইত্যাদি। তবে এর জন্য কিছু শর্ত পূরণ আবশ্যক।
এই দুই ক্ষেত্রেই বেশকিছু কাঠামোগত এবং অর্থনৈতিক বিষয় সম্পর্কিত। কিন্তু ইউক্রেন প্রেসিডেন্টের অভিলাষ তার লালিত ইচ্ছার দ্রুত বাস্তবায়ন। এর বাইরেও রয়েছে ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ। সব মিলিয়ে আমার মনে হয় ইউক্রেনের ওপরেই চাপটা বেশি। ইউক্রেনের মিত্র সংখ্যাও দৃশ্যত এখন উল্লেখযোগ্য নয়। তবে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আমার মনে হচ্ছে, এই যুদ্ধ বা আক্রমণ-প্রতিআক্রমণের বিষয়টি খুব প্রলম্বিত হবে না। লক্ষণীয়, এ কয়দিনের মধ্যে যেটুকু ঘটনা
ঘটেছে; এর বিরূপ প্রভাব নানা ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে। যে কোনো যুদ্ধে সর্বাগ্রে পরাজিত হয় মানবতা। সাধারণ নিরপরাধ মানুষ এর শিকার হয় বেশি। আমরা আমাদের একজন নাগরিকসহ এই যুদ্ধ পরিস্থিতির মর্মন্তুদ শিকার যাদের হতে দেখেছি তা অত্যন্ত বেদনার।


বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমাদের দিকটিও আলোচনায় সংগত কারণেই উঠে এসেছে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূলকথা- সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। এই নীতির নৈতিক ও রাজনৈতিক জোর দুই-ই আছে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে একটা বিষয় পরিস্কার- আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট দু-একটা সূত্রের ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা ও বিস্তৃতকরণের বিষয়টি খুব জরুরি। আমরা কিছুটা ভুল করেছি বলে আমি মনে করি। এ কারণে এ কথা বলছি, দীর্ঘমেয়াদে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সম্পর্কের মেরূকরণের ক্ষেত্রে এখন অধিকতর সজাগ-সতর্ক। শুধু চীন-রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রই নয়; ভারতও জড়িত আছে আমাদের নানা উন্নয়ন কিংবা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। ভারত বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় নানা কারণেই হিসাবের মধ্যে রয়েছে। এই বিষয়গুলো আমলে নিয়ে যদি বিশ্নেষণ করি তাহলে বলব, বাংলাদেশের বড় একটা কাজ হবে- সম্পর্কের দিগন্ত বিস্তৃতকরণে আরও মনোযোগী হওয়া। আমরা যেন কোনো বিষয়েই নির্দিষ্ট সূত্রের ওপরেই নির্ভর করে না থাকি। তবে এও মনে করি, বাংলাদেশ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদি কোনো বিরূপ প্রভাবের শিকার হবে না। স্বল্পমেয়াদে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং এ জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা জোরালো করা দরকার। গভীরভাবে লক্ষ্য করলে এও দেখা যায়, বড় দুটি দেশ চীন ও ভারত এ সংকটে জড়াতে চাচ্ছে না। এটি আমাদের জন্য ইতিবাচক বিষয়। আমরাও চাই সংকটের সমাধান হোক আলোচনার টেবিলে। মানবিক বিপর্যয় এড়াতে আলোচনাই একমাত্র পথ। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক রয়েছে, তা অটুট রাখতে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কূটনৈতিক তৎপরতা দরকার। আগেই বলেছি, আমাদের পররাষ্ট্রনীতির যে নৈতিক ও রাজনৈতিক জোর রয়েছে, তা আমাদের জন্য সর্বক্ষেত্রেই সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করি।
পশ্চিমা বিশ্বও মনে হয় ইউক্রেন সংকট নিরসনে সমঝোতার পথেই শেষ পর্যন্ত এগোবে। এর মধ্যে তারা যেসব নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে; মনে হয় না রাশিয়াকে তা কাবু করার অবস্থায় নিয়ে যাবে। এই সংকটের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বার্থও জড়িত। বিশেষ করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, এর জন্যও বিদ্যমান সংকট বড় একটা বিষয় হয়ে আছে। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে মনে করি, বাংলাদেশের উচিত রাশিয়া-ইউক্রেনের সমঝোতায় আসা কিংবা পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে বা যেতে পারে সেদিকে তীক্ষষ্ট নজর রাখা। একই সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ নিজেদের স্বার্থসংশ্নিষ্ট সব বিষয়েই বিকল্প সূত্রের সন্ধান এবং তা কার্যকর করা। পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আমাদের কূটনীতির লক্ষ্য সুবিন্যস্ত করে কাজের ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করার পাশাপাশি এর পরিসর বৃদ্ধির ব্যাপারেও দূরদর্শী কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এখন সম্পর্কের মাত্রা ও পরিধি গণ্ডিবদ্ধ রাখার অবকাশ নেই।
ইউক্রেন সংকটের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বলতে হয়, বড় আকারে সমস্যা হয়ে গেছে ন্যাটোর সম্প্রসারণ। ন্যাটোর সদস্য সংখ্যা দ্রুত দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে গেছে। আজ যদি পরিস্থিতি উল্টো হতো, যেমন- ওয়ারশ চুক্তি যেটা হয়েছিল তা যদি বাড়তে বাড়তে কথার কথা নেদারল্যান্ডস পর্যন্ত সম্প্রসারিত হতো, তাহলে স্বাভাবিকভাবে অনেক দেশ তা মানত না। বিশ্ব তো বটেই, বিশেষ করে ইউরোপকে এখন নতুনভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন। ইউরোপ যদি মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্র ধরে রাশিয়াকে ঠেলতে ঠেলতে কিনারে নিয়ে যাবে, সেটা রাশিয়া মানবে না। সৃষ্ট পরিস্থিতির সঙ্গে শুধু ভূ-রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক বড় সম্পর্কও রয়ে গেছে। কথা উঠেছিল, ইউরোপ যেন তাদের সামরিক শক্তি বাড়ায়। শোনা গেছে, জার্মানি নাকি তা কিছুটা বাড়াবেও। যদি তা-ই হয়, তাহলে জার্মানির উন্নয়ন ব্যাহত হবে এবং তা জার্মান জনগণ মানবে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ আছে। এ রকম পরিস্থিতি অন্যত্রও দেখা দিতে পারে। বিশ্বব্যবস্থা এখন বহুকেন্দ্রবিশিষ্ট হতে যাচ্ছে। এটা ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থামাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। আমাদের যে পররাষ্ট্রনীতি রয়েছে তা কাজে লাগিয়ে দীর্ঘমেয়াদে আমরা সুফল পেতে পারি, যদি সে রকম দূরদর্শী কূটনীতির প্রতিফলন ঘটানো যায়। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে এ কথাই বলা যায়, আমরা আগে থেকেই বহুকেন্দ্রিক সম্পর্কের দিকে আছি। কাজেই ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের জন্য ইতিবাচক বার্তা অপেক্ষা করছে। বহুকেন্দ্রবিশিষ্ট ব্যবস্থাটা যত জোরদার হবে, বাংলাদেশ ততই লাভবান হবে। আমরা কোনো সামরিক জোটে যাইনি, যাবও না। এটাই আমাদের সার্বিক শক্তি, যা পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় আরও নন্দিত হবে।
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়