বুধবার কুমিল্লার বিজয়পুরে ট্রেনের ধাক্কায় যে তিনটি শিশু মারা গেল, তা শুধু হৃদয়বিদারকই নয়; সংশ্নিষ্ট সবার একটা সতর্ক সংকেতও বটে। বৃহস্পতিবার সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই হতভাগ্য শিশুরা ছিল সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর রেলওয়ে সড়কের পশ্চিম পাশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। অন্যান্য দিনের মতো বুধবার সকাল সাড়ে ১১টায় তারা রেললাইন পেরিয়ে স্কুলে যাচ্ছিল। দুটি লাইনে একই সময়ে দুটি ট্রেন যাওয়ার পর দেখা যায়, রেললাইনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বই-খাতা, টিফিন বক্স এবং পাশে ওই তিন শিক্ষার্থীর ছিন্নভিন্ন দেহ। বস্তুত শিশুঘাতী এ দুর্ঘটনায় আমরা যত না শোকাহত, তার চেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ এ কারণে যে; দেশে নিয়মিত বিরতিতে প্রাণঘাতী ট্রেন দুর্ঘটনা প্রতিকারহীনভাবে ঘটে চলেছে। প্রায় প্রতিটি দুর্ঘটনা ঘটার পর এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়, তদন্ত হয়; আমরাও সম্পাদকীয় স্তম্ভে দুর্ঘটনা বন্ধের তাগিদ দিই। কর্তৃপক্ষও সাময়িক নড়েচড়ে বসে বটে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।
বিজয়পুরের ঘটনা রেলক্রসিংয়ের বাইরে বলে রেল কর্তৃপক্ষ হয়তো দায় এড়াতে চাইবে। কারণ, শুধূ রেল দুর্ঘটনা ও রেলক্রসিংয়ে অন্যান্য যানের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনার হিসাব ও তার দায় রেল কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে। কিন্তু যেখানে বিজয়পুর রেলওয়ে সড়কের পাশেই প্রাথমিক বিদ্যালয় অবস্থিত, সেখানে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ বা অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি কেন? সহযোগী এক দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যমতে, ঢাকার নারায়ণগঞ্জ থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত এলাকাটিতে রেলে কাটা পড়ে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে। সেখানে বছরে গড়ে ৩০০ মানুষ মারা যায়। বুধবারের ঘটনার অকুস্থল বিজয়পুরেও এর আগে এ রকম বহু ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এসব বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ খুব একটা দেখা যায় না।
রেল কর্তৃপক্ষ রেলস্টেশন বা রেল জংশনের কাছে পরাপারের জন্য ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করলেও সারাদেশে যানবাহন রেললাইন পার হওয়ার জন্য আড়াআড়ি সড়ক নির্মাণ করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। বস্তুত একাধিক কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের কারণে রেলের সার্বিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটছে এবং দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে। খবরে প্রকাশ, দেশের রেল সড়কের ৮২ শতাংশই অরক্ষিত। ট্রেন এলে যানবাহন কিংবা মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার কেউ না থাকার খেসারত কতটা ভয়ানক হতে পারে- কুমিল্লার তিন শিশুর মৃত্যুই তার প্রমাণ। রেল সড়কের ওপর দিয়ে স্বাভাবিক চলাচলই নয়; রীতিমতো হাটবাজার বসছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। কোথাও বস্তি কিংবা বাসাবাড়িও রেল সড়ক ঘেঁষে গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে আড্ডাখানাও। এমনকি রেলের জায়গা দখল করে রেল সড়কের পাশেই প্রভাবশালীরা মার্কেট গড়ে তুলেছে। এসব বন্ধ করতে না পারলে রেলপথ নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ করা সম্ভব হবে না।
নিরাপদ ও আরামদায়ক হিসেবে ট্রেনে ভ্রমণ অনেকেরই পছন্দের। তা ছাড়া সরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকায় রেলপথে চলাচল অনেক ক্ষেত্রেই সাশ্রয়ী। সড়কপথের মতো রেলপথও যদি অনিরাপদ ও দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়, তা দুঃখজনক। এটা স্পষ্ট- রেলের অব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তাহীনতা, জমি বেদখলসহ নানা কারণে প্রতিবছর এ খাতে সরকারকে ব্যাপক ভর্তুকি দিতে হয়। আমরা মনে করি, দেশের স্বার্থে রেল খাত লাভজনক করা ও এই পথে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন।
আমরা কুমিল্লায় রেলের ধাক্কায় তিন শিশুর মৃত্যুতে সংশ্নিষ্ট পরিবারগুলোর প্রতি সমবেদনা জানাই। নিহত তিন শিক্ষার্থীর পরিবারকে উপযুক্ত ও সম্মানজনক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করার আহ্বান জানাই। অনতিবিলম্বে বিজয়পুরের অকুস্থলসহ সারাদেশে সাধারণের জন্য নিরাপদে রেললাইন পারাপারের স্বার্থে ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করার আহ্বান জানাই। কুমিল্লার দুর্ঘটনা আমলে নিয়ে রেলের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নতুন করে ঢেলে সাজানো দরকার। একাধিক কর্তৃপক্ষ থাকলেও সবার মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সারাদেশের রেলপথ নিরাপদ করতেই হবে। এ ক্ষেত্রে রেল পুলিশকে আরও সতর্ক হতে হবে।

বিষয় : তিন শিশুর মৃত্যু

মন্তব্য করুন