এটি সর্বজনবিদিত- ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া নামক এক অজপাড়াগাঁয়ে যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছিলেন; কালের পরিক্রমায় তিনি হয়ে উঠেছেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা; হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি; স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি; মুক্তির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই মহান ব্যক্তি এখন শুধু বাঙালির বঙ্গবন্ধু নন; পৃথিবী নামক এই গ্রহে মানবিক আদর্শের নির্মাতা, মুক্তি-স্বাধীনতাকামী নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক অবিনাশী আলোকবর্তিকার পথিকৃৎ।
শৈশব-কৈশোর থেকে প্রচ্ছন্ন কীর্তির আড়ালে দেশপ্রেম, মানবকল্যাণ এবং আত্মপ্রত্যয়ের গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনে বঙ্গবন্ধু অতুলনীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ১৪৭৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিপ্লবসূচক নিকোলাস কোপারনিকাস; ১৪৮৩ সালের ১০ নভেম্বর খ্রিষ্টান ধর্মে প্রোটেস্টানিজম মতবাদের প্রবক্তা মার্টিন লুথার; ১৭৩২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট এবং আমেরিকানদের মুক্তিদাতা জর্জ ওয়াশিংটন; ১৭৭৪ সালের ১০ মে ব্রাহ্মধর্ম মতবাদ ও সতীদাহ প্রথার নিবারক ভারতের নবযুগের প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায়; ১৮২০ সালের ১২ মে আর্ত-মানবতা সেবাধর্মের মাতৃস্বরূপা ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল; ১৮৩৩ সালের ২১ অক্টোবর নোবেল পুরস্কার প্রণেতা আলফ্রেড নোবেলের জন্ম উল্লেখ্য সাল-তারিখকে করেছে চিরঞ্জীব ও চিরস্মরণীয়। যোগ্যতা-গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ডে গ্রহাণু আবরণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মও কালোত্তীর্ণ পরিকর্ষে অভিনন্দিত।
কবিগুরু রবিঠাকুরের 'আমি' শিরোনামে কবিতার প্রথম কয়েকটি পঙ্‌ক্তি যেন বঙ্গবন্ধুর জন্মকেই উৎসর্গ করা- "আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,/ চুনি উঠল রাঙা হয়ে।/ আমি চোখ মেললুম আকাশে, জ্বলে উঠল আলো/ পুবে পশ্চিমে।/ গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম, 'সুন্দর',/ সুন্দর হল সে।/ তুমি বলবে, এ যে তত্ত্বকথা, এ কবির বাণী নয়।/ আমি বলব, এ সত্য,/ তাই এই কাব্য।/ এ আমার অহংকার,/ অহংকার সমস্ত মানুষের হয়ে।/ মানুষের অহংকার-পটেই/ বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প।"
বস্তুত বাংলা নামক এই জনপদের সমাজ ইতিহাস সুদীর্ঘ প্রাচীন এবং ভিনদেশি শাসক-শোষকদের নিপীড়ন-নির্যাতন-যন্ত্রণা-বৈষম্যের স্মারক। এই বাংলার প্রথম স্বাধীন বাঙালি রাষ্ট্রনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। শৈশবকাল থেকেই গ্রাম্য পরিবেশে সাধারণ মানুষের জীবনকাব্যের নানান পরিচ্ছেদে পরিপূর্ণ সুখ-দুঃখের স্মৃতি নিয়েই বঙ্গবন্ধু তার অসাধারণ মানবধর্মী জীবনানুসন্ধানে নিজেকে বিলীন করে দিলেন ত্যাগের মহাসমুদ্রে। মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের নান্দনিক-মাঙ্গলিক পরিশিষ্টে বাঙালি জাতির অনন্য অহংকার কবি রবিঠাকুর ও নজরুলের অসাধারণ শতবর্ষ ধারণকে বারবার উচ্চারণের আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত করার নয়। বিশ্বের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু কৈশোর থেকে শুরু করে সারাটা জীবন ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর যে আদর্শিক চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছেন বাঙালির হৃদয় গভীরে; সুদৃঢ় প্রোথিত কবি রবিঠাকুর ও নজরুলের কাব্য পাঠোদ্ধারে তাকে শুধু শতবর্ষে নয়; শত শত বছর পরেও যথাযোগ্য মর্যাদায় তার অবিস্মরণীয় আদর্শ প্রচারিত হবেই।
বাংলাদেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রগতিশীল সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী আবুল ফজলের ভাষায়, 'বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও সর্বাধিক উচ্চারিত নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের ইতিহাসের তিনি শুধু নির্মাতা নন, তার প্রধান নায়কও। ঘটনাপ্রবাহ ও নিয়তি তাঁকে বারবার এ নায়কের আসনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বলা যায়, যেন হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছে। শত চেষ্টা করেও তাঁর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। ইতিহাস দেয় না তেমন কিছু করতে। ইতিহাস নিজের অঙ্গ নিজে করে না ছেদন। শেখ মুজিব ইতিহাসের তেমন এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাংলাদেশের শুধু নয়, বিশ্ব-ইতিহাসেরও।'
বস্তুত বিস্ময়কর চরিত্রের বঙ্গবন্ধু নামের এই মহান পুরুষের বিশ্বে কোনো বিকল্প নেই। তিনিই একমাত্র তার বিকল্প প্রতিচ্ছবি হতে পারেন। আধুনিক মানবসভ্যতার মনন-সৃজনশীল-দেশপ্রেম-মাটি ও মানুষের প্রতি অপরিমেয় মমত্ববোধের স্পন্দিত অধ্যায় রচনায় শেষ গন্তব্য পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ব্যাপ্তিত থাকবেন- নিঃসংকোচে তা ব্যক্ত করা মোটেও অযৌক্তিক বা অমূলক নয়। ১৭ মার্চ এই মহামানবের জন্মবার্ষিকীতে তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়