
সিদ্ধেশ্বরী হাই স্কুলে পড়ি। উঁচু ক্লাসে। যুক্ত হয়েছি ছাত্র ইউনিয়নে। ক্লাসের পরে, পড়ন্ত বিকেলে, স্কুল ফাঁকা। কয়েকজন ফাঁকা ক্লাসরুমে আড্ডা দিই। মূল ঘটনা ভিন্ন। সঙ্গে একবার কি দুইবার কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ, সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম হাজির। মার্ক্সিজম, কমিউনিজম বিষয়ে জানান, বোঝান। উদ্দীপ্ত হই। রক্তে ক্রমে মিশে যায়। ভিন্ন রাজনীতি দু'চক্ষের বিষ। নাম শুনলে ক্ষিপ্ত। বলতে শুরু করেছি- আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিবুর রহমান আমেরিকার দোসর, সাম্রাজ্যবাদী। দূর হ। মস্কো-রাশিয়া আমাদের আদর্শ। স্বপ্ন।
ছাত্র ইউনিয়নের চেয়ে ছাত্রলীগের ছাত্রের সংখ্যা বেশি। দেশব্যাপী সমর্থকও। পেশিশক্তি, দাপট আইয়ুব বা মোনায়েম খানের এনএসএফের। সরকারি সাহায্যপুষ্ট। হত্যা করলেও সাত খুন মাফ। ওরা মূলত বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক। কয়েকটি কলেজেও। পঁচাত্তর নয়, 'পাঁচপাত্তর' নামে এক ছাত্রনেতার নাম চারদিকে খুব ফেটেছে। এনএসএফের পাণ্ডা। কখন কাকে গুম করে, ভয়ে তটস্থ। কিন্তু রবীন্দ্রমন্ত্রে বলীয়ান :'বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি।' দাঁড়ালে কার সাধ্য হেলায়?
ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়েছি। বাড়ি থেকে সাবধান, হুঁশিয়ারি। ছাত্র ইউনিয়নের মিটিং থেকে এক দিন একটু রাত করে ফেরায় সোনাউ (জিয়া হায়দার) কৈফিয়ৎ চান। বলি। থাপ্পড় মেরে মাথা ঘুরিয়ে দিলেন। 'লেখাপড়া নেই, রাজনীতি? আগে লেখাপড়া, পরে রাজনীতি।' মার খেয়ে জেদ আরও চাপল। মুখে অপ্রকাশিত। ছাত্র ইউনিয়নের সব মিটিংয়ে হাজির। সন্ধ্যার আগে ঘরে ফেরা। বিদ্যাসাগরের 'গোপাল সুবোধ বালক'।
রুশপন্থি সমাজতন্ত্রীদের নিয়ে নানা কুকথা, গুজব। একটি বসন্তে ঝলমলে নরম রোদ মৃদুমন্দ বায়ু, ফুল, গাছগাছালি, প্রকৃতি শোভাময়। একজনের হাতে খোলা ছাতি, মাথায় দিয়ে যাচ্ছেন। 'কেন ভাই? রোদবৃষ্টি তো কিছুই নেই।' ছত্রধারীর উত্তর- 'মস্কোয় বৃষ্টি হচ্ছে।'
ব্রেজনেভের মাথাব্যথা, সর্দি হওয়ার আশঙ্কা- ভেবেই ফার্মেসিতে গিয়ে ওষুধ, অ্যাসপিরিন কিনে পকেটে রাখে পূর্ণ কমিউনিস্টরা (রুশপন্থি)।
বহুমান্য লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও কম যাননি। ব্যঙ্গ করতে ছাড়েননি, 'চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসে। ছাত্র ইউনিয়নকে 'হারমোনিয়াম পার্টি' বলে বিদ্রুপ করেছেন। করতেই পারেন। ভুলে গেছেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (ষাটের দশকের কথা বলছি) এবং বাংলাদেশে বাংলার ঐতিহ্য, সুস্থ সংস্কৃতির ধারা এখনও বহমান; হারমোনিয়াম পার্টিরই অবদান। হোক তা নবান্ন, বসন্ত, বৈশাখ, সংগীত উৎসব। চারুকলা, নাট্যমেলা। দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্র উৎসব। বাউল মেলা। বাংলার আদি তথা ঐতিহ্যের সংস্কৃতি চারিয়ে দেওয়ার মূলে অন্য কোনো রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের আছে কি? কতটা?
শেখ মুজিবুর রহমান জেলে, মুক্তির আন্দোলন শুরু। জোয়ারতরঙ্গ ক্রমেই উত্তাল। সহপাঠী-বন্ধু সেলিম (প্রয়াত) গানবাজনায় মশগুল, ছাত্রলীগে নিবেদিতপ্রাণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতাদের চেনেন ওঁর বাবার সুবাদে, বললেন একদিন :'দুই-এক লাইনের মধ্যে, কবিতার মতো করে স্লোগান লিখে দে।' লিখলুম চারটে। নিয়ে গেলেন নেতাদের কাছে। পরদিন বললেন :"দোস্ত, দুটি বাদ। 'আগলতলা ষড়যন্ত্র মানি না/ পাকিস্তান চিনি না।' 'আমরা সবাই ভাই ভাই/ মুজিব ছাড়া মুক্তি নাই।' চলবে না। বাদ সেধেছেন ছাত্র সংগ্রাম কমিটির কয়েকজন নেতা। তবে 'কারাগার ভাঙবো/ শেখ মুজিবকে আনবো' এবং 'পদ্মা-মেঘনা-যমুনা/ বাংলাদেশের ঠিকানা' পছন্দ করেছেন। দু-একটি শব্দ বদলাবেন।"
হয়ে গেল :'জেলের তালা ভাঙবো/ শেখ মুজিবকে আনবো।' 'তোমার-আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা।'
সেলিমের মুখেই শুনলাম, 'তোর নেতা সাইফউদ্দিন মানিক বলেছেন, বাংলাদেশ কেন লিখেছেন জিজ্ঞেস করো। ছেলেটাকে চিনি।' মোহাম্মদ ফরহাদের কাছে শুনেছি :'তোমার না আর কারোর লেখা প্রমাণ নেই। কপিরাইট নেই।' কপিরাইট কী, জানতুম না।
না জানলেও বিস্ময় মানি, শেখ মুজিবুর রহমান ভিন্ন দলীয় নেতা হওয়া সত্ত্বেও গোটা দেশ একাত্ম, তাঁর মুক্তির সংগ্রামে। প্রত্যেকে মরিয়া। মুসলিম লীগ, জামায়াত, পাকিস্তানপ্রেমী বাদে।
১৯৬৯ সালে, গণআন্দোলনকালে শেখ মুজিবকে নিয়ে, শেখ মুজিবের মুক্তি নিয়ে দলমত নির্বিশেষে দেশ এতটা উত্তাল, এতটা সংগ্রামমুখর; নানা স্লোগান রচনা কল্পনাতীত। সব মনে নেই, একটি :'মুজিব ছাড়া দেশ নাই/ মুজিব ছাড়া জীবন নাই।'
বিপ্লব, সংগ্রামেই জনতার মুখরিত আন্দোলনেই বহু শ্রেষ্ঠ কবিতা, স্লোগান রচিত। বাংলাদেশেও। যেমন বাংলা ভাষা আন্দোলন, শহীদ দিবস নিয়ে সাহিত্যের মূল্যের চেয়ে সমকালীনতার চিত্রপট ঐতিহাসিক। দেশীয় আঙ্গিক। চারিত্রিক। প্রেক্ষাপটে। যেমন, কার লেখা জানিনে, 'যে দেখেনি পাকিস্তানি শাসন/ সে বুঝবে না বঙ্গবন্ধুর ভাষণ।'
দেখেছি পাকিস্তানি শাসন (জন্ম :২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সাল), বুঝেছি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ (৭ মার্চ ১৯৭১-এ, রেসকোর্সে)।
সকাল ১১টার আগেই হাজির। মঞ্চের সামনে বসে। পাছে, জায়গা যদি না পাই!!
শুনলাম :'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'
রক্তে আন্দোলন। কথামালায় সংগ্রাম, স্বাধীনতার বীজ। উদ্দীপ্ত দেশ। মানুষ। শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে যান বঙ্গবন্ধু। সব বন্ধু আপন, আত্মিক হয় না। শেখ মুজিবুর রহমান হন।
বলবার কথা এই, পূর্ব পাকিস্তানে বহু নেতার আগমন, গমন। শেখ মুজিব কেন স্লোগানে, কবিতায়, ছড়ায় বহুধা? তৈত্তরীয় উপনিষদে :'সংকটকালের ত্রাতা কে? ত্রাতাই মান্য জীবনে।'
শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে যান বঙ্গবন্ধু। দেশের বঙ্গবন্ধু। বন্ধুর জন্মদিনে উদ্বেলিত। মাথা নত। শুভেচ্ছা।
'যে দেখেনি পাকিস্তানি শাসন/ সে বুঝবে না বঙ্গবন্ধুর ভাষণ।'
দাউদ হায়দার: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
ছাত্র ইউনিয়নের চেয়ে ছাত্রলীগের ছাত্রের সংখ্যা বেশি। দেশব্যাপী সমর্থকও। পেশিশক্তি, দাপট আইয়ুব বা মোনায়েম খানের এনএসএফের। সরকারি সাহায্যপুষ্ট। হত্যা করলেও সাত খুন মাফ। ওরা মূলত বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক। কয়েকটি কলেজেও। পঁচাত্তর নয়, 'পাঁচপাত্তর' নামে এক ছাত্রনেতার নাম চারদিকে খুব ফেটেছে। এনএসএফের পাণ্ডা। কখন কাকে গুম করে, ভয়ে তটস্থ। কিন্তু রবীন্দ্রমন্ত্রে বলীয়ান :'বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি।' দাঁড়ালে কার সাধ্য হেলায়?
ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়েছি। বাড়ি থেকে সাবধান, হুঁশিয়ারি। ছাত্র ইউনিয়নের মিটিং থেকে এক দিন একটু রাত করে ফেরায় সোনাউ (জিয়া হায়দার) কৈফিয়ৎ চান। বলি। থাপ্পড় মেরে মাথা ঘুরিয়ে দিলেন। 'লেখাপড়া নেই, রাজনীতি? আগে লেখাপড়া, পরে রাজনীতি।' মার খেয়ে জেদ আরও চাপল। মুখে অপ্রকাশিত। ছাত্র ইউনিয়নের সব মিটিংয়ে হাজির। সন্ধ্যার আগে ঘরে ফেরা। বিদ্যাসাগরের 'গোপাল সুবোধ বালক'।
রুশপন্থি সমাজতন্ত্রীদের নিয়ে নানা কুকথা, গুজব। একটি বসন্তে ঝলমলে নরম রোদ মৃদুমন্দ বায়ু, ফুল, গাছগাছালি, প্রকৃতি শোভাময়। একজনের হাতে খোলা ছাতি, মাথায় দিয়ে যাচ্ছেন। 'কেন ভাই? রোদবৃষ্টি তো কিছুই নেই।' ছত্রধারীর উত্তর- 'মস্কোয় বৃষ্টি হচ্ছে।'
ব্রেজনেভের মাথাব্যথা, সর্দি হওয়ার আশঙ্কা- ভেবেই ফার্মেসিতে গিয়ে ওষুধ, অ্যাসপিরিন কিনে পকেটে রাখে পূর্ণ কমিউনিস্টরা (রুশপন্থি)।
বহুমান্য লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও কম যাননি। ব্যঙ্গ করতে ছাড়েননি, 'চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসে। ছাত্র ইউনিয়নকে 'হারমোনিয়াম পার্টি' বলে বিদ্রুপ করেছেন। করতেই পারেন। ভুলে গেছেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (ষাটের দশকের কথা বলছি) এবং বাংলাদেশে বাংলার ঐতিহ্য, সুস্থ সংস্কৃতির ধারা এখনও বহমান; হারমোনিয়াম পার্টিরই অবদান। হোক তা নবান্ন, বসন্ত, বৈশাখ, সংগীত উৎসব। চারুকলা, নাট্যমেলা। দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্র উৎসব। বাউল মেলা। বাংলার আদি তথা ঐতিহ্যের সংস্কৃতি চারিয়ে দেওয়ার মূলে অন্য কোনো রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের আছে কি? কতটা?
শেখ মুজিবুর রহমান জেলে, মুক্তির আন্দোলন শুরু। জোয়ারতরঙ্গ ক্রমেই উত্তাল। সহপাঠী-বন্ধু সেলিম (প্রয়াত) গানবাজনায় মশগুল, ছাত্রলীগে নিবেদিতপ্রাণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতাদের চেনেন ওঁর বাবার সুবাদে, বললেন একদিন :'দুই-এক লাইনের মধ্যে, কবিতার মতো করে স্লোগান লিখে দে।' লিখলুম চারটে। নিয়ে গেলেন নেতাদের কাছে। পরদিন বললেন :"দোস্ত, দুটি বাদ। 'আগলতলা ষড়যন্ত্র মানি না/ পাকিস্তান চিনি না।' 'আমরা সবাই ভাই ভাই/ মুজিব ছাড়া মুক্তি নাই।' চলবে না। বাদ সেধেছেন ছাত্র সংগ্রাম কমিটির কয়েকজন নেতা। তবে 'কারাগার ভাঙবো/ শেখ মুজিবকে আনবো' এবং 'পদ্মা-মেঘনা-যমুনা/ বাংলাদেশের ঠিকানা' পছন্দ করেছেন। দু-একটি শব্দ বদলাবেন।"
হয়ে গেল :'জেলের তালা ভাঙবো/ শেখ মুজিবকে আনবো।' 'তোমার-আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা।'
সেলিমের মুখেই শুনলাম, 'তোর নেতা সাইফউদ্দিন মানিক বলেছেন, বাংলাদেশ কেন লিখেছেন জিজ্ঞেস করো। ছেলেটাকে চিনি।' মোহাম্মদ ফরহাদের কাছে শুনেছি :'তোমার না আর কারোর লেখা প্রমাণ নেই। কপিরাইট নেই।' কপিরাইট কী, জানতুম না।
না জানলেও বিস্ময় মানি, শেখ মুজিবুর রহমান ভিন্ন দলীয় নেতা হওয়া সত্ত্বেও গোটা দেশ একাত্ম, তাঁর মুক্তির সংগ্রামে। প্রত্যেকে মরিয়া। মুসলিম লীগ, জামায়াত, পাকিস্তানপ্রেমী বাদে।
১৯৬৯ সালে, গণআন্দোলনকালে শেখ মুজিবকে নিয়ে, শেখ মুজিবের মুক্তি নিয়ে দলমত নির্বিশেষে দেশ এতটা উত্তাল, এতটা সংগ্রামমুখর; নানা স্লোগান রচনা কল্পনাতীত। সব মনে নেই, একটি :'মুজিব ছাড়া দেশ নাই/ মুজিব ছাড়া জীবন নাই।'
বিপ্লব, সংগ্রামেই জনতার মুখরিত আন্দোলনেই বহু শ্রেষ্ঠ কবিতা, স্লোগান রচিত। বাংলাদেশেও। যেমন বাংলা ভাষা আন্দোলন, শহীদ দিবস নিয়ে সাহিত্যের মূল্যের চেয়ে সমকালীনতার চিত্রপট ঐতিহাসিক। দেশীয় আঙ্গিক। চারিত্রিক। প্রেক্ষাপটে। যেমন, কার লেখা জানিনে, 'যে দেখেনি পাকিস্তানি শাসন/ সে বুঝবে না বঙ্গবন্ধুর ভাষণ।'
দেখেছি পাকিস্তানি শাসন (জন্ম :২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সাল), বুঝেছি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ (৭ মার্চ ১৯৭১-এ, রেসকোর্সে)।
সকাল ১১টার আগেই হাজির। মঞ্চের সামনে বসে। পাছে, জায়গা যদি না পাই!!
শুনলাম :'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'
রক্তে আন্দোলন। কথামালায় সংগ্রাম, স্বাধীনতার বীজ। উদ্দীপ্ত দেশ। মানুষ। শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে যান বঙ্গবন্ধু। সব বন্ধু আপন, আত্মিক হয় না। শেখ মুজিবুর রহমান হন।
বলবার কথা এই, পূর্ব পাকিস্তানে বহু নেতার আগমন, গমন। শেখ মুজিব কেন স্লোগানে, কবিতায়, ছড়ায় বহুধা? তৈত্তরীয় উপনিষদে :'সংকটকালের ত্রাতা কে? ত্রাতাই মান্য জীবনে।'
শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে যান বঙ্গবন্ধু। দেশের বঙ্গবন্ধু। বন্ধুর জন্মদিনে উদ্বেলিত। মাথা নত। শুভেচ্ছা।
'যে দেখেনি পাকিস্তানি শাসন/ সে বুঝবে না বঙ্গবন্ধুর ভাষণ।'
দাউদ হায়দার: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
মন্তব্য করুন