
শুরুতে কথা ছিল- বিশ্বায়ন হবে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। বাণিজ্যকে বাধাহীনভাবে বিশ্বব্যাপী পরিচালনা করার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতিমালা হবে বিশ্বায়ন। সারা বিশ্বে পণ্য ও পুঁজির অবাধ প্রবাহ থাকবে। কিন্তু কী হলো? সারা বিশ্বকে এক কেন্দ্র থেকে শাসন করার নতুন অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কৌশল তৈরি হলো। দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণে ধনী রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক প্রভাব পড়ল। বিশ্বায়ন হলো উপনিবেশের এক নব্য রূপ। বিশ্বায়নের ফলে পুঁজিবাদীরা তাদের পুঁজি বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। বিশ্বায়ন দিয়ে তারা নব্য উপনিবেশ তৈরি করতে পেরেছে। বিশ্বায়নের নাম দিয়ে পুঁজিবাদীরা বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার বৈধতা পেয়েছে। সামরিক শক্তিকে ব্যবহার না করে বিশ্বায়নকে ব্যবহার করে এখন সারা বিশ্বকে এক কেন্দ্র থেকে শাসন করা হচ্ছে।
বর্তমান বিশ্বায়নের বিকাশে সবচেয়ে বেশি অবদান বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির। প্রয়োজনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে একের পর এক তাঁবেদারি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন, যা বিশ্বায়নকে বিকশিত করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। তবে বিশ্বায়নকে প্রথমদিকে এমনভাবে প্রচার করা হয়; যেমন বিশ্বায়ন প্রতিষ্ঠা হলে গরিব দেশগুলোই বেশি লাভবান হবে। কিছুটা যে হয়নি, তা নয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লাভবান হয়েছে পরাশক্তিগুলো। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গরিব দেশগুলো।
বিশ্বায়নের ধারণাটা পুঁজিবাদী ও ধনী শাসকশ্রেণির। তাই তারা যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জি-২০, নিরাপত্তা পরিষদ, ন্যাটো প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন তৈরি করে ধনী রাষ্ট্রগুলো তাদের সুবিধার জন্য বিশ্বায়নকে ব্যবহার করছে। এসব দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক খুবই ভালো। এসব দেশের মধ্যে ভিসা ছাড়াই তারা চলাচল করতে পারে। একে অপরের বিপদে এগিয়ে আসে। এসব রাষ্ট্র একসঙ্গে কাজ করে। আর সব অসুবিধা ভোগ করতে হয় গরিব ও অনুন্নত দেশগুলোকে।
বিশ্বব্যাপী সামরিক খাতে ব্যয়ের মাত্র ১ শতাংশ অর্থ দিয়ে পৃথিবীর প্রত্যেক শিশুকে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড় করানো সম্ভব। বিশ্বায়নের ফলে বেড়েছে বৈষম্য, ক্ষুধা, দারিদ্র্য। ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ; বাড়ছে বিভেদ-হানাহানি সমাজে। বিশ্বায়নের ফলে সারা বিশ্বে বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটেছে। মানুষ আদিম যুগ থেকে আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে; উন্নতমানের জীবনের স্বপ্ন দেখতে পেরেছে। উন্নত যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারছে। বিশ্বায়নের ফলে মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ করতে পারছে। মানুষ তার নিজের এবং তার দেশের পার্থক্যটা বুঝতে পারছে। বিশ্বায়নের ফলে মানুষের মধ্যে উন্নতির ছোঁয়া এসেছে। বিশ্বায়ন এমন একটা বিষয়, যা দ্বারা অনেক সমস্যা যেমন তৈরি করা হয়েছে, তেমন বিশ্বে যে সমস্যা আছে, তার সমাধানও করা হচ্ছে।
তবে এই মুহূর্তে পৃথিবীর রং বোঝা কঠিন হয়ে পড়ছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন, রাশিয়া তার ঘরের পাশে ন্যাটো সামরিক জোটের নতুন কোনো তৎপরতা কোনোভাবেই সহ্য করবে না। আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটো জোট রুশের এই বার্তা অগ্রাহ্য করেছে। যার ফলে ইউরোপকে আবারও 'যুদ্ধের দুঃস্বপ্ন' দেখতে হচ্ছে এবং এর প্রভাব গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। সুইডেন, ফিনল্যান্ড তাদের সীমান্তে সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ করেছে। জনগণের মধ্যে আতঙ্কের ছাপ পড়েছে। প্রতিদিন বিশ্বে করোনা মহামারিতে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। ভয়ভীতির শেষ নেই। কী হবে-না হবে- এটাই এখন প্রশ্ন। সব সমস্যা মিলে দুর্বিষহ অবস্থা। ঠিক তেমন একটি সময় রাশিয়ার হুঁশিয়ারি সংকেত পারমাণবিক অস্ত্রের আক্রমণ! এই হচ্ছে বিশ্বের তথা ইউরোপের বর্তমান পরিস্থিতি।
যে ধারণা নিয়ে বিশ্বায়নকে পদায়ন করা হয়েছিল, সে ধারণা যদি প্রতিষ্ঠিত হতো তবে সবাই এর সুফল পেত। বিশ্বায়ন সমস্যা তৈরিতে সহায়ক না হয়ে যদি সমাধানে সহায়ক হয়, তবে আমরা উপকৃত হবো। প্রযুক্তি তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেওয়ায় ক্ষীণ হলেও একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে যদি এ প্রতিযোগিতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন ময়দানে দেখা যাবে পণ্য, মুদ্রা, প্রযুক্তি ও ধারণার লড়াই। এ লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কে জেতে, তা-ই এখন দেখার অপেক্ষা।
রহমান মৃধা: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
rahman.mridha@gmail.com
মন্তব্য করুন