- মতামত
- মৃত্যুসংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তির দায় ল্যানসেটের
করোনা পরিস্থিতি
মৃত্যুসংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তির দায় ল্যানসেটের

দেশে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেটের গবেষণা প্রতিবেদনটি বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। ব্যক্তিগতভাবে ওই প্রতিবেদনের ভাষ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। তারা কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এমন প্রতিবেদন তৈরি করেছে, তা অবশ্যই প্রশ্নের বিষয়। ২০১৯ সালে দেশে যত মানুষ মারা গেছেন, তার চেয়ে কত বেশি ২০২০ বা ২০২১ সালে মারা গেছেন; সে পার্থক্যটা জানতে পারলে বিষয়টি পরিস্কার হতো। করোনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত অথবা করোনার কারণে যারা অন্য রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা না নিতে গিয়ে মারা গেছেন কিংবা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন, সেই সংখ্যা তো করোনায় মৃত্যুর তালিকার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না।
আফ্রিকার মডেল অনুযায়ী আমাদের এখানে পরিসংখ্যান নির্ণয় করাটাই তো ভুল। আমাদের এখানে যত মানুষ মারা যান তাদের কবর দেওয়া হয়, অথবা শ্মশানে দাহ করা হয়। যদি তাদের নির্ণয়কৃত সংখ্যা অনুযায়ী আমাদের হিসাবের বাইরে অতিরিক্ত মারা গিয়ে থাকেন, তাহলে তাদের কবর কোথায়? অনেক ক্ষেত্রেই শ্মশান পারিবারিক বা সর্বজনীন রয়েছে। তাছাড়া শ্মশানে দাহ করার পর শবদেহের সৎকারের চিহ্ন থাকে না। কিন্তু কবর তো অচিহ্নিত বিষয় নয়। যদি এত বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটেই থাকে, তাহলে নতুন নতুন কবরে ছেয়ে যাওয়ার কথা। আমরা জানি, করোনায় সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ মারা গেছেন ঢাকায়। অনিবন্ধিত কবর খুঁজে বের করুক তারা। মফস্বল বিশেষ করে গ্রামে যে গোরস্তান আছে সেখানে যে সংখ্যক লাশ দাফন করা হয়েছে, এর বাইরে আর কোথায় দাফনের ক্ষেত্র আছে?
ল্যানসেট ইচ্ছামাফিক গড় অঙ্ক কষে বাংলাদেশের ঘাড়ে এত গুণ মানুষের করোনায় মৃত্যুর যে কথা বলেছে, এর যুক্তি কী? তা যদি হয়ে থাকে তবে আমরা আপত্তি তুলতাম না; বিষয়টি সঠিক পন্থায় নির্ণিত হতো। আমি করোনাকালে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বহুবার বলেছি, সংক্রমণের সংখ্যা যখন প্রকৃত সংখ্যার চেয়েও ঊর্ধ্বমুখী থাকে, তখন এর হার ৩০-৪০ গুণ হতে পারে। কিন্তু মৃত্যু তো অদৃশ্য কোনো কিছু নয়; এটি দৃশ্যমান। মৃত্যু লুকানো কীভাবে সম্ভব? বাংলাদেশে লাশ দাফন করার জায়গা না পেয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে- এমন একটি উদাহরণও কি আমাদের সামনে আছে? এমন ঘটনা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে ঘটেছে। আর ঘটেছে সেটা নানা কারণে। কিন্তু বাংলাদেশে একটি শবদেহ কি দাফন বা সৎকার হয়নি- এমন দৃষ্টান্ত কেউ দিতে পারবে?
একজন নাগরিক যদি তথ্য অধিকার আইনে এখানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে তথ্য চান গোরস্তানে দাফন করা বা শ্মশানে সৎকারের, তাহলে তালিকা পাওয়া কঠিন কিছু নয়। কারণ আমাদের দেশে জন্ম-মৃত্যু সরকারিভাবে রেকর্ড করা হয়। করোনাকালে তা আরও বিশেষভাবে তদারকির ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদে মৃত্যুর খবর জানিয়ে দাফন বা সৎকার করতে হয়। দু-তিন মাস সময় নিয়ে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের মাধ্যম থেকে সংগৃহীত সংখ্যা ভুল হওয়ার আশঙ্কা ক্ষীণ।
আমরা জানি, তথ্য সংগ্রহ সব সময় একেবারে শতভাগ সঠিক হয় না। সে ক্ষেত্রে সরকার প্রকাশিত মৃত্যুর সংখ্যা আর ল্যানসেটের প্রকাশিত সংখ্যার মধ্যে যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখা গেল, তা বিস্ময়কর বৈকি! ল্যানসেটের যতই খ্যাতি কিংবা পরিচিতি থাক, তাই বলে তারা যা বলবে, এটাই গ্রহণযোগ্য কিংবা সঠিক মনে করার যৌক্তিক কারণ নেই। যদি ল্যানসেটের তথ্য সঠিক হয়, তাহলে আমরা ভুল স্বীকার করব- আমাদের পদ্ধতিগত ত্রুটি ছিল। কিন্তু তারা যেহেতু এমন অবিশ্বাস্য একটা তথ্য তুলে ধরেছে, সেহেতু তাদেরই তা প্রমাণ করতে হবে। এটা তাদের দায়।
সরকারি হিসাবে যত মানুষ মারা গেছে; নিশ্চয় দেশে মৃত্যুসংখ্যা এর চেয়ে বেশি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- তা কত বেশি? এমন পাহাড় আর সমতল চিত্র তো অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য নয়। জোনোসাইড স্টাডিজের গবেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ কয়েকবার প্রকাশ করেছেন করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন তাদের সংখ্যা। এর যদি আমরা দ্বিগুণ হিসাবও করি তার পরও তো ল্যান্ডসেটের সঙ্গে অসংগতি যে ব্যাপক; তা দেখা যাচ্ছে। সরকারি হিসাবে দেশে মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে সার্বিকভাবে ১০ শতাংশের বেশি মৃত্যু হয়েছে- এমন কোনোই আশঙ্কা নেই।
করোনার মৃত্যুসংখ্যা নির্ণয়ে ল্যানসেট বৈজ্ঞানিক কোনো পন্থা যদি অনুসরণ করে থাকে; সে ক্ষেত্রেও তাদের প্রক্রিয়া-পদ্ধতি সঠিক নয় বলে মনে করি। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের এ ব্যাপারে স্টাডি করার পাশাপাশি ল্যান্ডসেটের তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে তাদের জবাবদিহি আদায়ের ব্যবস্থা করতেই হবে। মুখের কথায় জবাব নয় বিধায় দেশের বিজ্ঞানীদের এ ব্যাপারে স্টাডি প্রয়োজন বলে মনে করি। আক্রান্তের শতভাগ সঠিক তথ্য বের করা একটু কঠিন হলেও করোনায় মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করা মোটেও কঠিন নয়।
সব শেষে বলি, করোনা নিয়ে আমরা শঙ্কামুক্ত আছি- এ কথা না ভাবাই ভালো। আবার ঢেউ আসবে। তবে টিকাদান কর্মসূচির যেহেতু ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছে, সেহেতু ঢেউটা এত তীব্র হবে না। গুরুতর অসুস্থের সংখ্যাও কম হবে। কিন্তু নতুন কোনো ধরন যদি আবার দেখা দেয়ই, তখন পরিস্থিতি কী হবে বা হতে পারে, সেই নিরিখে আমাদের প্রস্তুতি রাখা দরকার। তিন মাস পর আরেকটা ঢেউ আসার আশঙ্কা রয়েছে নতুন ধরন দেখা না দিলেও। যেমন চীনে এত সতর্কতা অথচ সেখানে এখনও অনেক রোগী। জাপান, হংকংসহ আরও কয়েকটি দেশের চিত্রও তা-ই।
আইইডিসিআর যে কাজটা করছে তা আরও গতিশীল করতে হবে। কোথাও নতুন করে সংক্রমণ দেখা দিলে শনাক্তের পাশাপাশি তালিকা করে চিকিৎসা ব্যবস্থা সুচারুর জন্য স্বাস্থ্য বিভাগকে সতর্ক থাকতে হবে। সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের বিকল্প নেই। অর্থাৎ বিষয়টা এ রকম- অগ্নিকাণ্ডের খবর শোনামাত্র যেন ফায়ার ব্রিগেড পূর্ণ সক্ষমতা নিয়ে অবস্থার প্রেক্ষাপটে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোও সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দাবি।
ডা. মুশতাক হোসেন: রোগতত্ত্ববিদ; সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)
মন্তব্য করুন