আসিফ সালেহ্‌ ২০১৯ সাল থেকে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১১ সালে ব্র্যাকে যোগ দিয়ে নীতিনির্ধারণী বিভিন্ন পদে কাজ করেন। ব্র্যাকে যোগদানের আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে 'এটুআই' কর্মসূচির নীতি বিশেষজ্ঞ এবং তারও আগে আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা সংস্থা গোল্ডম্যান স্যাক্সের নির্বাহী পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া গ্ল্যাক্সো ওয়েলকাম, আইবিএম এবং নরটেলের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। ২০১৩ সালে তিনি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ইয়ং গ্লোবাল লিডার নির্বাচিত হন। আসিফ সালেহ্‌ কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক এবং নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির স্টার্ন স্কুল অব বিজনেস থেকে ব্যবস্থাপনা ও মার্কেটিংয়ে এমবিএ করেছেন।

সমকাল: ব্র্যাকের পঞ্চাশ বর্ষপূর্তিতে আপনাকে শুভেচ্ছা। গত অর্ধশতকে এই প্রতিষ্ঠান দেশের কতটা প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছাপ রেখে এসেছে, তার সামান্য সাক্ষী আমি নিজেও। আমার বাড়ি কুড়িগ্রামের রৌমারীতে। শৈশবে সেখানে আমরা দেখতাম, শিমুলগাছ ঘেরা একটি পতিত জমি 'ব্র্যাকের জায়গা' হিসেবে পরিচিত ছিল। সেখানে স্থাপনা উঠেছে অনেক পরে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে।

আসিফ সালেহ্‌: ও, তাই নাকি! ব্র্যাকের যাত্রা শুরুর দিনগুলোতে রৌমারী একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। প্রথম কর্মএলাকা সুনামগঞ্জের শাল্লার পর রৌমারী দ্বিতীয় কর্মএলাকা। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদও ওই জনপদে কাজ করার স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা আজীবন মনে রেখেছিলেন।

সমকাল: ব্র্যাক তখনই, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী দিনগুলোতে, কেবল রৌমারীর মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে নয়, কীভাবে বৈশ্বিক হয়ে উঠেছিল, তার প্রমাণও সম্প্রতি পেয়েছি। টুইটারে রৌমারীর ছবি দেখে এক ব্রিটিশ ভদ্রলোক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তিনি ১৯৭৪-৭৫ সালে সেখানে ব্র্যাকের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন।

আসিফ সালেহ: এটা আমাদের জন্য খুবই কৌতূহলোদ্দীপক খবর। ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে যোগাযোগ হলে ভালো লাগবে। আমরা আসলে একটা প্রকল্পও হাতে নিয়েছি। ব্র্যাকের শুরুর দিনগুলোর ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা ধরে রাখার জন্য। এতে যে চারটি এলাকা বেছে নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে রৌমারী একটি। ওই ভদ্রলোকের অভিজ্ঞতা আমাদের নিশ্চয়ই কাজে লাগবে।

সমকাল: বস্তুত ব্র্যাকের নিজের গল্পও আজ বিশ্বজুড়ে কৌতূহল ও বিস্ময়-জাগানিয়া। আমরা জানি, লন্ডনের বাড়ি বিক্রির ৬ হাজার ৮০০ পাউন্ড দিয়ে শুরু করছিলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। সেখান থেকে এখন বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। গত ৫০ বছরে এমন অনেক সংগঠন তৈরি হয়েছে, স্থবির হয়ে গেছে, বন্ধও হয়ে গেছে। আমাদের সংক্ষেপে বলুন, ব্র্যাকের টিকে থাকা এবং ক্রমাগত টেকসই ও সম্প্রসারিত হওয়ার মূল ম্যাজিকটা কী?

আসিফ সালেহ্‌: ম্যাজিক যদি বলেনই, এর কয়েকটি দিক আছে। একটা হচ্ছে, ব্র্যাক সব সময় পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে সময়ের সঙ্গে থাকতে চেষ্টা করেছে। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা সব সময় বলতেন, ব্র্যাককে প্রাসঙ্গিক থাকতে হবে। আরেকটি হচ্ছে, ব্র্যাক সব সময় সমস্যার গভীরে গিয়ে কাজ করেছে। ব্র্যাক একটি সামাজিক সংগঠন, এর কাজ সামাজিক সমস্যা সমাধান করা। যদি সমাজ না বুঝি, সমাজের সমস্যাগুলো না বুঝি, তাহলে তো সমাধান করতে পারব না। যে কারণে প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্র্যাকের কাজের তাৎপর্য ও প্রভাব বাংলাদেশের সমাজের গভীরে গ্রোথিত রয়েছে।

সমকাল: বাংলাদেশের সমাজে ব্র্যাকের প্রভাব ও তাৎপর্যের দু-একটি উদাহরণ বলবেন?

আসিফ সালেহ্‌: যেমন এক চিমটি লবণ, একমুঠ গুড়, আধা সের পানি দিয়ে খাবার স্যালাইন তৈরির পদ্ধতি ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিয়েছিল ব্র্যাক। এর ফলে দেশের ডায়রিয়া রোগ প্রতিরোধে সামাজিক সামর্থ্য তৈরি হয়েছিল। সাধারণ মানুষের রোগ প্রতিরোধ চিত্র পাল্টে গিয়েছিল। যেমন ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় আনা। কেন সন্তানদের স্কুলে পাঠায় না, সেটা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জানতে চাওয়া। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে শিক্ষার আওতায় আনা, প্রশিক্ষণ দিয়ে গৃহবধূদেরই শিক্ষক বানানো। স্কুলকে বাড়ির পাশে নিয়ে যাওয়া। এগুলোর প্রতিটির পেছনে গভীর চিন্তা ও দর্শন ছিল। সেই চিন্তা ছিল মানুষকেন্দ্রিক। মানুষের সমস্যা ভালো করে বুঝে সমাধান দেওয়া।

সমকাল: ব্র্যাকের বেড়ে ওঠার পেছনের আরেকটি বিষয় কম আলোচিত, তা হচ্ছে ব্যক্তিনির্ভরতার বদলে প্রাতিষ্ঠানিকতা। এটা সম্ভবত সাফল্যের আরেকটি প্রধান মন্ত্র।

আসিফ সালেহ্‌: ব্যক্তিনির্ভর ব্যবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারলেই একটা অর্গানাইজেশন বড় হয়। এ জন্য কঠোর শৃঙ্খলা দরকার হয়, স্বচ্ছতা দরকার হয়। সর্বোপরি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের একটা সংস্কৃতি প্রয়োজন হয়। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা এসব বিষয়ে সব সময় খুব জোর দিতেন। তিনি মনে করতেন, ব্যক্তির ভাবমূর্তি দিয়ে সংগঠন বেশিদিন চলতে পারে না। ব্যক্তি না থাকলেও যাতে সংগঠন চলতে পারে, সে জন্য সিস্টেমগুলো তৈরি করা। তিনি নিজেতে সাংঘাতিক ইন্টেগ্রিটিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। সেই কর্মসংস্কৃতি তিনি কর্মীদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। যে কারণে ব্র্যাকের কর্মীদের মধ্যেও একটা অন্য ধরনের গর্ব কাজ করে। তারা কাজ করেন সামাজিক অঙ্গীকারের জায়গা থেকে। এ ব্যাপারে ব্র্যাক সব সময় আপসহীন থেকেছে।

সমকাল: কর্মসূচিগুলোর ব্যাপকতাও কি ব্র্যাককে অন্যান্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা থেকে আলাদা করেছে?

আসিফ সালেহ্‌: ঠিকই বলেছেন, ব্র্যাক সব সময় বড় আকারে চিন্তা করেছে। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ দেখেছেন, আমাদের দেশে রিসোর্স কম। যে কারণে কোনো একটি উন্নয়ন মডেল যদি কাজ করেছে, সেটাকে সারাদেশে নিয়ে গেছেন। আড়ং মডেলটা যখন কাজ করল, যখন দেখা গেল নাগরিক রুচিতে এর চাহিদা আছে, অনেক তাঁতি ও কারুশিল্পীর কর্মসংস্থান হচ্ছে, তখন তিনি চিন্তা করলেন এটাকে আরও বড় করতে হবে। আড়ং একটি ব্যতিক্রমী ব্র্যান্ড। কিন্তু ওটা করতে গিয়ে উনি কখনও দারিদ্র্যের গল্প বিক্রি করেননি। আড়ংয়ের পণ্য বিক্রি করে দরিদ্রদের সাহায্য করা হচ্ছে- এমন প্রচার করেননি। গল্প বিক্রি করতে গিয়ে অনেকের মূল পণ্যের কোয়ালিটি আর থাকে না। তিনি চিন্তা করলেন, আড়ং যদি বড় করতে হয়, তাহলে প্রোডাক্টটা সেল করতে হবে। তাহলে মানুষের কর্মসংস্থান হবে। ফজলে হাসান আবেদ সব সময় বলতেন, বিজনেসকে ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, মানুষকে বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। টেকসই সমাধানের জন্য এটা জরুরি। এই কারণে দেখবেন যে, আমাদের উদ্যোগগুলো শুরু হয়েছে এক একটি উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে। এগুলো বড় হয়ে, লাভজনক হয়ে আমাদের মূল উন্নয়ন কর্মসূচিতে অবদান রেখেছে।

সমকাল: আমাদের সামনে কিছু উদাহরণ আছে, যেখানে বড় বড় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রাজনৈতিক ও সামাজিক বিতর্ক ও টানাপোড়েনের কারণে সংকটে পড়েছে। ন্যায্য-অন্যায্য যাই হোক, মূল কাজের ক্ষেত্রে একটা নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ব্র্যাক কীভাবে এমন পরিস্থিতি এড়িয়ে সম্প্রসারিত হয়ে চলছে?

আসিফ সালেহ্‌: স্যার ফজলে হাসান আবেদ কখনও ব্যক্তিকে সামনে আনেননি, সব সময় সংগঠনকে সামনে রেখেছেন। মূল কাজটি যাতে হয়, সেই চেষ্টা করেছেন। রাজনৈতিক অভিলাষ তার কখনোই ছিল না। প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নের যে লক্ষ্যে ব্র্যাকের সৃষ্টি, সেই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওয়ার অকারণ কোনো ঝুঁকি নেননি। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ধরে রেখেই সব সময় রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে চেয়েছেন।

সমকাল: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব উন্নয়ন সংস্থা কাজ করে, তার মধ্যে ব্র্যাকই একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যারা তৃতীয় বিশ্বে জন্ম নিয়ে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। কাজ করতে গিয়ে এ কারণে কি কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন?

আসিফ সালেহ্‌: চ্যালেঞ্জ বলব না, বরং বলব যুদ্ধ করতে হয় আমাদের। বৈশ্বিক উন্নয়ন ডিসকোর্স এতটাই ঔপনিবেশিক ও পক্ষপাতমূলক যে, যেসব টেবিলে বসে সিদ্ধান্ত হয়, সেখানে জায়গা করে নিতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়। প্রতিনিয়ত বলতে হয়, আমাদেরও অধিকার আছে। বলতে পারেন, আমরা ব্র্যাকের মডেল দিয়ে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ডিসকোর্সকে চ্যালেঞ্জ করে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা বলছি, প্রকল্পনির্ভর উন্নয়ন চলবে না। সমস্যার গভীরে যেতে হবে। উন্নয়নের স্থানীয়করণ খুবই জরুরি। সমস্যা যেই জায়গায়, সমাধান সেখান থেকেই আসতে হবে। পশ্চিমা উন্নয়ন সংস্থাগুলো তাদের উন্নয়ন ধারণা আমাদের দেশে রপ্তানি করতে চায়। আমরা বলছি, বাইরে থেকে আমদানি করা সমাধান কাজ করবে না। আপনি বলতে পারেন, ব্র্যাক মডেলের মধ্য দিয়ে ডিকলোনাইজেশন অব ডেভেলপমেন্ট ডিসকোর্স ঘটেছে। বৈশ্বিক উন্নয়ন ধারণার ডিকলোনাইজেশন ঘটিয়েছে ব্র্যাক।

সমকাল: ব্র্যাকের উন্নয়ন দর্শন আরেকটু ব্যাখ্যা করে বলবেন?

আসিফ সালেহ্‌: আমাদের উন্নয়নের দর্শন হলো, মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন মানুষ নিজেই করতে পারে। ব্র্যাক কারও ভাগ্য পরিবর্তন করে দেয় না। আমরা মনে করি, প্রত্যেকের মধ্যে সম্ভাবনা রয়েছে। দারিদ্র্য, সামাজিক শোষণ, নানা প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকে সেই সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে পারে না। এ ক্ষেত্রে আমরা তাদের কিছু টুলস দিতে পারি মাত্র, সেটা অর্থনৈতিক, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যবিষয়ক হতে পারে। একবার যদি আত্মবিশ্বাস তৈরি করে দেওয়া যায়, তাহলে পিছিয়ে পড়া মানুষ নিজেই তার ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। ব্র্যাক শুধু সেই আত্মবিশ্বাস তৈরি করে দেয়। প্রচলিত উন্নয়ন ধারণা হচ্ছে- ওরা গরিব, ওদের সাহায্য করো। আপনি দেখবেন, আমরা কখনও গরিব মানুষের ছবি দেখিয়ে সাহায্য চাই না।

সমকাল: ব্র্যাকসহ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর বড় টুলস হচ্ছে ক্ষুদ্রঋণ। সমালোচনা রয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে পারেনি। আপনি কী বলবেন?

আসিফ সালেহ্‌: আমি বলব, ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য নিয়ে নব্বইয়ের দশকে অতিরঞ্জন হয়েছে। বলা হয়েছে, মানুষকে ক্ষুদ্রঋণ দাও, সে তার ভাগ্য পরিবর্তন করবে। ক্ষুদ্রঋণ আসলে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরণের একটি টুলস মাত্র। শুধু একটি টুলস দিয়ে মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে নিয়ে আসা যায় না। এ জন্য চার-পাঁচটি টুলস লাগতে পারে। সেটা অর্থনৈতিক হতে পারে, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যবিষয়ক হতে পারে। সব ক্ষেত্রেই দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। সব মিলে দারিদ্র্য থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারে। ক্ষুদ্রঋণ অন্যতম উপকরণ। যারা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তাত্ত্বিক তর্ক করেন, তারা ঢাকার বাইরে একটু ঘুরে এলেই দেখতে পাবেন কীভাবে সংকটের সময় ক্ষুদ্রঋণ মানুষকে সমর্থন দেয়।

সমকাল: অতিরঞ্জনের বাইরে বাস্তবেও ক্ষুদ্রঋণের বিদ্যমান ব্যবস্থার কি পরিবর্তন দরকার?

আসিফ সালেহ্‌: দেখুন, গত দুই বছরে করোনা পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন গ্রামে সাধারণ মানুষের তারল্য সংকট দেখা দিয়েছিল। শ্রমজীবী মানুষের একটি বড় সংকট থাকে তারল্য সংকট। কারণ, গ্রামের মানুষের একটা সময় বেশ টাকা আসে, তারপর একটা বড় সময় কোনো টাকা থাকে না। ক্ষুদ্রঋণ ওই তারল্য সংকটের সময় কাজ করে। ক্ষুদ্রঋণের যে সংজ্ঞা নব্বইয়ে দশকে ছিল, এখন সেটা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন নানা ধরনের সার্ভিসও দেওয়া হচ্ছে। যারা চাকরি করেন, তারা যদি ব্যবসা করতে চান, তাদের জন্য ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেভিংস প্রোডাক্ট রয়েছে নারীদের জন্য। ডিপিএসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি বলব, ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে সমালোচনার ধরনও বদলানোর সময় এসেছে।

সমকাল: প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেখা গেছে, প্রতি দশকে ব্র্যাকের নতুন কর্মসূচি বা অগ্রাধিকার থাকে। ৫০ বছরের বড় মাইলফলকে দাঁড়িয়ে কর্মসূচিগত অগ্রাধিকার কী?

আসিফ সালেহ্‌: এখন ব্র্যাকের দুটো দিক আছে। একটা বাংলাদেশ প্রেক্ষিত, আরেকটি বৈশ্বিক প্রেক্ষিত। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যদি দেখি, গত ৫০ বছরে দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বড় উন্নতি হয়েছে। আমরা এখন গ্রামবাংলায় গেলে আগের মতো অপুষ্টি দেখি না। মানুষ খালি গায়ে, খালি পায়ে থাকে না। আপনি রৌমারীর কথা বলেছেন। দেখবেন, স্বাধীনতার পরের আর এখনকার রৌমারীর মধ্যে অনেক পার্থক্য। তার মানে এই নয় যে, আমাদের দেশে গরিব মানুষ নেই। এখনও আমাদের দেশে দুই কোটি অতিদরিদ্র মানুষ আছে। এর মানে, দেশের কিছু পকেটে এখনও দারিদ্র্য প্রকট। সেটা উত্তরবঙ্গেও কোনো পকেট হতে পারে, হাওরাঞ্চলের কোনো পকেট হতে পারে। সেখানে আমাদের আরও কাজ করতে হবে।

সমকাল: সামাজিক সংকট কি আগের তুলনায় বেড়েছে?

আসিফ সালেহ্‌: সামাজিক সমস্যা তো অনেক আছে। বিশেষ করে সমাজের নিচের দিকে সংকট বেড়েছে। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেক দেশের তুলনায় সুষম ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসমতা বাড়ছে। এটা ক্রমান্বয়ে আরও বাড়বে।

সমকাল: অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসমতা কি সুশাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত?

আসিফ সালেহ্‌: সুশাসনের প্রশ্নটি তো আছেই। সুশাসনের পাশাপাশি দেখতে হবে কর্মসংস্থানের বিষয়টি। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকরণের বিষয়গুলো। একজন তরুণ যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হচ্ছে, আমাদের দেখতে হবে তার সামনে কোনো মই আছে কিনা। একটা ভালো চাকরি পাচ্ছে কিনা, উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য সুযোগ পাচ্ছে কিনা।

সমকাল: গত বছর ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সময় আপনি যে চারটি অগ্রাধিকারের কথা বলেছিলেন, তার একটি তরুণদের সম্পৃক্তি ও কর্মসংস্থান। এ ছাড়া ছিল নগরায়ণ, পরিবেশ, সমতার। এ ক্ষেত্রে আগামী দিনগুলোতে কী করবেন?

আসিফ সালেহ্‌: এই দশকে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে ব্র্যাক। এ ছাড়া পরিবেশ নিয়ে নতুন নতুন পরিকল্পনা রয়েছে। স্বাস্থ্য নিয়েও আমরা কাজ করেছি। অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ে বড় আকারে কাজ শুরু হয়েছে। এগুলোকে আগে বড়লোকের অসুখ বলা হতো। কিন্তু এখন এগুলো সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষেরও অসুখ। এসব নিয়ে আরও ব্যাপক হারে কাজ শুরু করতে হবে।

সমকাল: উন্নয়নকাজে সরকারের সক্ষমতা আগের তুলনায় বেড়েছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রাসঙ্গিকতা কি কমছে?

আসিফ সালেহ্‌: আমি মনে করি, প্রাসঙ্গিকতা কমেনি; বরং বেড়েছে। এটা ঠিক, এখন সরকারি সংস্থাগুলোর শক্তি, ক্ষমতা ও সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। আমরা দেখতে পারি, কীভাবে সরকারি ব্যবস্থাকে আরও জনবান্ধব ও কার্যকর করা যায়। যেমন সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। সেগুলোতে আমাদের স্বাস্থ্যসেবিকাদের যুক্ত করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তাহলে উইন উইন একটা পরিস্থিতি হবে। এভাবে আমাদের আরও বেশি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। কেবল সরকার নয়; সামাজিক আন্দোলনগুলোর সঙ্গে কীভাবে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে কাজ যায়, তা নিয়েও ভাবা হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই এখন ব্র্যাক সবকিছু নিজে না করে সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চায়। কেবল বাংলাদেশে নয়, বাংলাদেশের বাইরেও আমরা একই কর্মকৌশল গ্রহণ করছি। আফ্রিকাতে আমরা অনেক কর্মসূচি গ্রহণ করেছি।

সমকাল: শেষ করি। ব্র্যাকে যোগ দেওয়ার আগে আপনার কাজের ক্ষেত্রে ভিন্ন ছিল। এখন নিজে বদলে যাচ্ছেন, না ব্র্যাককে বদলে দিচ্ছেন?

আসিফ সালেহ্‌: আমার মনে হয় দুটোই। তবে আমি বদলেছি বেশি। আমি তো ব্র্যাকে যোগ দেওয়ার আগে ব্যক্তি খাতে বেশি কাজ করেছি। প্রযুক্তি বিষয়ে পড়ালেখা করেছি, এমবিএ করেছি। তবু ব্র্যাকে এসে আমার অভিজ্ঞতা ট্রান্সফার করতে পেরেছি। আগে তো উন্নয়ন কর্মসূচি তেমন বুঝতাম না। নীতিগত বিষয় নিয়ে কাজ করেছি। ব্র্যাকে যোগদানের সময় আমাদের প্রতিষ্ঠাতা বলেছিলেন, উন্নয়নকাজ করতে হলে হাতে ধুলাবালি লাগাতে হবে। আমি সানন্দেই সেই ধুলাবালি লাগানোর কাজ করে যাচ্ছি।

সমকাল: প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

আসিফ সালেহ্‌: সমকালের জন্যও শুভেচ্ছা।