রোববার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেড়ে যাওয়া মুন্সীগঞ্জগামী এমএল আফসার উদ্দিন নামে লঞ্চটিকে শীতলক্ষ্যা নদীতে ধাক্কা দেয় এমভি রূপসী-৯ নামে একটি কার্গো জাহাজ। মুহূর্তেই নিকটপাল্লার লঞ্চ আফসার উদ্দিন পানির নিচে তলিয়ে যায়। সেই দৃশ্য সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, আফসার উদ্দিন ডুবে যাওয়ার সময় বেশ কয়েকজন যাত্রী লঞ্চ থেকে লাফ দিচ্ছেন। তবে বেশিরভাগ যাত্রীই বের হতে পারেননি। বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের বর্ণনায় জানা যায়, লঞ্চটিতে ৭০ জনের মতো যাত্রী ছিলেন। এর মধ্যে ১৫-২০ জন যাত্রী সাঁতার কেটে তীরে আসতে পেরেছেন।
আমি যখন এ লেখাটি লিখছি তখন পর্যন্ত সাতজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ পাঁচ যাত্রী নিখোঁজের কথা বলছে। দুর্ঘটনার ১৬ ঘণ্টা পর উদ্ধারকারী জাহাজ 'প্রত্যয়' ৫৫ হাত পানির নিচ থেকে ডুবে যাওয়া লঞ্চটি উদ্ধার করেছে। তবে লঞ্চে আর জীবিত বা মৃত কোনো যাত্রীর সন্ধান মেলেনি। হয়তো পানির স্রোতে অনেকে ভেসে গেছেন অথবা সাঁতার কেটে বা অন্য কোনো নৌযানের সহায়তায় কেউ কেউ জীবিত উদ্ধার হয়েছেন।
২০০৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বরিশাল থেকে মেহেন্দীগঞ্জগামী (বরিশাল জেলার একটি উপজেলা) এমএল হ্যাপী নামে এ রকম একটি ছোট লঞ্চ ডুবে যায় কীর্তনখোলা নদীতে। সে সময় আমাদের গ্রাম উলানিয়ার মানিক দেব ও দীপ্তি রানী দাস এবং তাদের সন্তান অনিক-ঐশী- একই পরিবারের ৪ জনের প্রাণহানির পর একটি জাতীয় দৈনিকে এসব মান্ধাতার আমলের ছোট লঞ্চ বন্ধের দাবি জানিয়ে লিখেছিলাম।
আমাদের দেশে দুই ধরনের যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করে- দূরপাল্লা ও নিকটপাল্লা। দূরপাল্লার লঞ্চের নামের আগে এমভি (মোটর ভেসেল) লেখা থাকে, আর নিকটপাল্লার লঞ্চের নামের আগে থাকে এমএল। দূরপাল্লার লঞ্চ সাধারণত ঢাকা-বরিশাল, ঢাকা-ভোলা, ঢাকা-চাঁদপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে অন্যান্য রুটে চলাচল করে। এসব লঞ্চ দোতলা থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত হয়ে থাকে। আধুনিক ইঞ্জিন ও বিলাসবহুল নৌযান হিসেবে ঢাকা-বরিশাল রুটে বেশ কয়েকটি লঞ্চ এরই মধ্যে সবার দৃষ্টি কেড়েছে। অপরদিকে নিকটপাল্লার লঞ্চ একতলা থেকে দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এসব লঞ্চ আন্তঃজেলা বা আন্তঃবিভাগে চলাচল করে। যেমন বরিশাল-ভোলা, ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ ইত্যাদি।
নিকটপাল্লার লঞ্চের বেশিরভাগই ফিটনেসহীন। কিন্তু মালিকের ক্ষমতা আর নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিআইডব্লিউটিএর নীরবতা বা উদাসীনতায় দিনের পর দিন এসব লঞ্চ চলাচল করছে। অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, বরিশাল থেকে আমাদের উপজেলা মেহেন্দীগঞ্জ কিংবা বরিশাল থেকে ভোলা যেতে কীর্তনখোলা ও কালাবদরের মতো বড় নদীতে এসব লঞ্চ চলাচল অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। আর ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ বা মুন্সীগঞ্জ রুটে যেসব লঞ্চ চলাচল করে, সেগুলো আরও বেশি ছোট ও ঝুঁকিপূর্ণ। এই রুট দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-মোংলা রুটের পণ্যবাহী কার্গো জাহাজের পাশাপাশি বড় বড় নৌযান চলাচল করে। ফলে এসব ছোট লঞ্চকে ধাক্কা দেওয়ার দরকার নেই। গ্রিনলাইন ওয়াটারওয়েজ যাওয়ার সময় পানির ঢেউ সামলে ওঠার ক্ষমতা এমএল আফসার উদ্দিনের মতো লঞ্চের আছে বলে মনে করি না।
শুধু নিকটপাল্লার লঞ্চই ঝুঁকিপূর্ণ- এমনটা ভাবার অবকাশ নেই। দূরপাল্লার রুটেও অনেক ফিটনেসহীন লঞ্চ চলাচল করছে। দুর্ঘটনা শুধু নিকটপাল্লার লঞ্চডুবিতে হচ্ছে- এটাও ঠিক নয়। চাঁদপুরে এমভি সালাউদ্দিন, ভোলায় কোকো ও মুন্সীগঞ্জে পিনাকি লঞ্চডুবিতে অসংখ্য যাত্রীর প্রাণহানির কথা আমরা ভুলে যাইনি। তাই নিকটপাল্লা ও দূরপাল্লার সব ফিটনেসহীন নৌযান চলাচল বন্ধ করতে হবে। জানি, এসব লঞ্চের রুট পারমিট বাতিল অত সোজা নয়। কারণ এসব পরিবহনের মালিকের পরিচয় ও প্রভাব সম্বন্ধে আমরা কমবেশি অবগত। এর পরও আশায় বুক বাঁধতে চাই- এবার অন্তত সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। শীতলক্ষ্যায় দুর্ঘটনার পর ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ রুটে সাময়িক লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। নৌযান চলাচল বন্ধ কোনো সমাধান নয়, বরং এসব ছোটখাটো লঞ্চ চলাচল স্থায়ীভাবে বন্ধ করে বড় আকারের লঞ্চ চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। যদিও ভোলাসহ দক্ষিণাঞ্চলের অন্যান্য রুটে চলাচলকারী বেশ কয়েকটি লঞ্চ মুন্সীগঞ্জ ঘাটে নিয়মিত ভিড়ে থাকে।
মিজান শাজাহান: সাংবাদিক
mizanshajahan@gmail.com