অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা হলো এমন একটি শিক্ষা কাঠামো, যা সব ধরনের শারীরিক, মানসিক ও আর্থসামাজিক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে সুশিক্ষিত হয়ে উঠতে শিক্ষার্থীদের সাহায্য করে। ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতেও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে চিহ্নিত। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার চতুর্থ লক্ষ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সব শিশুর জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমতাপূর্ণ ও মানসম্মত সুশিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। তবে এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাঝে রয়েছে বিস্তর ফারাক।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, এ দেশে প্রতিবন্ধী শিশুদের সাক্ষরতার হার ৩৩ শতাংশ। একই বছর ইউনিসেফ প্রকাশিত তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে ৯৭ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও ৮৯ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিশু সে সুযোগ গ্রহণ করতে পারে না। এর মানে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থার কথা কাঠামোতে থাকলেও তা প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ঠিক 'অন্তর্ভুক্তিমূলক' হয়ে উঠছে না। কভিড-১৯ এর সময়ে সে সমস্যা আরও বিস্তৃত।
দেশে যখন কভিড-১৯ মহামারি প্রবলভাবে আঘাত হানে, তখন সরকারি সিদ্ধান্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শিক্ষাগ্রহণ থেমে থাকেনি। করোনার বন্ধে অনলাইনে শিক্ষকরা পাঠদান করেছেন; অনেক শিক্ষার্থী অনলাইনেই ক্লাস করেছে ও পরীক্ষা দিয়েছে। তবে ইন্টারনেটের অপ্রাপ্যতা, ডিজিটাল জ্ঞানের স্বল্পতা, শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি কারণে পাঠদান প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে। বিআইজিডি ও পিপিআরসির গবেষণা বলছে, শহরাঞ্চলের বস্তিতে বসবাসরত ৩৬ শতাংশ ও গ্রামাঞ্চলের ৪৪ শতাংশ পরিবারের শিক্ষার্থীদের কাছেই পাঠ গ্রহণের জন্য দরকারি বিভিন্ন উপকরণ যেমন স্মার্টফোন, ট্যাব, কম্পিউটার ইত্যাদি ছিল না। আমরা জানি, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য সাধারণ পাঠদান পদ্ধতি নয়; প্রয়োজন বিশেষায়িত পাঠদান পদ্ধতি, যা যথাযথভাবে প্রণয়ন করতে হলে প্রয়োজন এ বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান, দক্ষতা ও সম্পদ। কিন্তু আমাদের শিক্ষা কাঠামোতে কভিড-১৯ পূর্ববর্তী সময়েও এসব বিষয়ে যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা ছিল। অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর সে সীমাবদ্ধতা আমাদের কাছে আরও স্পষ্ট হয়েছে। মহামারিকালে কীভাবে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা এ ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেবে, তা নিয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে কোনো নীতি বা সিদ্ধান্ত দৃশ্যমান হয়নি।
কভিড-১৯ শুরুর আগে যখন সশরীরে পাঠদান চলত, তখন আমরা দেখেছি সব স্কুলে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রবেশগম্য পরিবেশ নেই। যেমন, শারীরিকভাবে যারা প্রতিবন্ধী, বিশেষত যারা হাঁটতে পারে না, তাদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢালু রাস্তা (র‌্যাম্প) অপ্রতুল। যারা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী তাদের জন্য ব্রেইল বই নেই। অনেক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ব্রেইলে পড়তেও অভ্যস্ত নয়। আবার শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য ব্যবহূত হয় সাংকেতিক ভাষা বা সাইন ল্যাংগুয়েজ। 'স্ট্যান্ডার্ড সাইন ল্যাংগুয়েজ' ও 'লোকাল সাইন ল্যাংগুয়েজ'- এ দুই ধরনের ভাষার রূপের ভিন্নতা থাকায় শিক্ষার্থীদের পাঠদানে স্বাভাবিক সময়েই অসুবিধা হয়। সশরীরে পাঠদানকালেই যদি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা এত সমস্যার মুখোমুখি হন, তাহলে অনলাইনে পাঠদানের সময় সমস্যাগুলো কতটা প্রকট, তা একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়।
যারা বাকপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী; প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করে দিলে তারা হয়তো অনলাইনে যোগ দিতে পারবেন, তবে পাঠে অংশগ্রহণ ও সাড়া প্রদানে অসুবিধার সম্মুখীন হবেন। যারা শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী, তারা অনলাইন ক্লাসের সময় শুনতে পাবেন না। তাই তাদের জন্য উপযুক্ত সাইন ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করা প্রয়োজন হবে। যারা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী, তাদের জন্য দরকার ব্রেইল। নইলে ক্লাসে কী পড়ানো হচ্ছে, তা তারা বুঝতে পারবেন না। আবার প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের আলাদা ক্লাস না নিয়ে যদি সবার সঙ্গেই পড়ানো হয়, তাহলে তারা অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়বেন। কারণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের আলাদা যত্ন ও সময় নিয়ে শিক্ষা দেওয়া দরকার। বহুমুখী প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী (যাদের একই সঙ্গে একের বেশি প্রতিবন্ধকতা আছে) ও অটিজমে আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে শিক্ষণের পুরো ব্যাপারটি আরও জটিল আকার ধারণ করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানে সফলতা তখনই আসবে, যখন আর্থসামাজিক বাধাসহ উপরোক্ত বাধাগুলো কাটিয়ে তারা অনলাইন ক্লাসে যোগ দেবেন।
প্রতিবন্ধিতার রয়েছে বিভিন্ন ধরন। সে ধরন অনুযায়ী শিক্ষকরা কীভাবে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পাঠদান করবেন, সে ব্যাপারে শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়াও জরুরি। শুধু শিক্ষকরা নন; যিনি বা যারা তাদের সেবায় নিয়োজিত; যেমন পিতামাতা বা নিকটাত্মীয়, তাদেরও বিশেষ প্রশিক্ষণ ও উৎসাহ দেওয়া দরকার। একই সঙ্গে যদি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালানো যায়, তা সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করবে। আশার কথা হলো, সরকারি নির্দেশানুযায়ী সম্প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলা হয়েছে। তবে আমাদের উচিত ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক থাকা। এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না- আগামীতেও কভিড-১৯ এর মতো অবস্থা পৃথিবীতে দেখা দেবে না। ভবিষ্যতের কথা ভেবে ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা কাঠামোতে যুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সময় এসেছে এখনই। অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রকৃত অর্থে সংযুক্ত করতে হলে বিভিন্ন দিক থেকে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সে জন্য আমাদের দেশে তাদের সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা প্রয়োজন।
দীপান্বিতা ঘোষ ও জিহাদ আল মেহেদী: যথাক্রমে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিআইজিডি) রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ও কমিউনিকেশন্স অফিসার