
কিছু কিছু বিষয় আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। এর মধ্যে একটি প্রধান বিষয়- চাকরিবাণিজ্য। আজ থেকে ১৫ বছর আগেও বিষয়টি অনেকটা সহ্যের মধ্যে ছিল। এক সময় সরকারি কর্মচারীদের বেতন ছিল কম। সেটা হঠাৎ বেড়ে যাওয়াতে বাজারে যেমন আগুন ধরল, তেমনি চাকরি দেওয়ার দালালরা ঝাঁপিয়ে পড়ল চাকরিপ্রার্থীদের ওপর। সম্প্রতি শুরু হচ্ছে ৪৫ হাজার প্রাইমারি স্কুল শিক্ষকের চাকরি। বাজারটি যেমন বড়, তেমনি প্রায় ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে একটি চাকরি হয়। তাহলে ৪৫ হাজার চাকরির মূল্য কত দাঁড়ায়? ৬৭৫০ কোটি টাকা। হিসাবে ভুল করলাম না তো? এসব পূরণ, ভাগ ছোট্ট একটা ক্যালকুলেটর নিয়ে শিক্ষা বিভাগের অসাধু কর্মচারীরা দ্রুতই করে ফেলেন। এই ৬৭৫০ কোটি টাকার মালিকানায় অনেকেই রয়েছেন। ইতোমধ্যে ভাগাভাগি হয়ে গেল কিনা, বলা যায় না। তৃণমূল থেকে শুরু করে বিভাগ, জেলা-উপজেলা, সচিবালয়, সংসদ, আইন রক্ষাকারী সংস্থা এবং প্রশ্ন ফাঁসকারী প্রেস থেকে শুরু করে সবাই তো এর ভাগ পাবে।
অনেক দিন আগে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছিলাম- এখানে ঘুষ কী করে বন্ধ করা যায়? তিনি বলেছিলেন, আমরা মৌখিক পরীক্ষার নম্বর কমিয়ে দিয়েছি। কারণ, আমাদের ধারণা, ওই জায়গাতেই দুর্নীতি বেশি হয়। পরবর্তী সময়ে একজন সচিবকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- বিষয়টির কী করে ফয়সালা করা যায়? তিনি বলেছিলেন, তাদের ধরা খুব মুশকিল। জেলা শিক্ষা অফিসগুলোতে এই চক্রটা বাসা বেঁধেছে পাকাপোক্তভাবে। আশ্চর্যের বিষয়, এ কাজে তারা খুব সৎ। ধরুন, তারা ১০ জনের কাছ থেকে টাকা নিল। যাদের চাকরি হলো না; তাদের টাকা তারা ফিরিয়ে দিয়ে পরবর্তী বছরের জন্য এভাবে আস্থা অর্জন করার চেষ্টা করে থাকে। এখন তো দেখা যাচ্ছে, প্রশ্নপত্র থেকেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। যারা এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তারা বহু আগে থেকেই এই ৪৫ হাজারের ওপর নজর রাখছে। এই ৪৫ হাজার চাকরি তাদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আর ঘুম কেড়ে নিয়েছে পরীক্ষার্থীদেরও, যাদের ১৫ লাখ করে টাকা জোগাড় করতে হবে। এরই মধ্যে জায়গা-জমি, বাড়িঘরের একটা অংশ বিক্রির ব্যবস্থাও শুরু হয়ে যাচ্ছে চাকরি পাওয়ার আশায়।
শিক্ষা প্রশাসনের এ ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। কারণ যারা জড়িত, তারা বহু বছর হলো চাকরিতে প্রবেশ করেছে। নানা ফাঁকফোকর তাদের ভালো করে জানা। যে লোকটি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তার ছেলেমেয়েরা হয়তো বিএ বা এমএ পাস করে প্রশাসনে অথবা অন্য কোথাও গুরুত্বপূর্ণ চাকরিতে যোগ দিয়েছে। স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত আমীর হামজার ছেলের মতো প্রশাসনে চাকরিরত অবস্থায়ই পিতার নামটি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আশীর্বাদে পদকপ্রাপ্তদের তালিকায় ঢুকে গিয়েছিল। কাজেই প্রয়াত পিতাকে নিয়ে দুর্নীতি করা যে আমলার বিবেকে বাধেনি; আজকে অসাধু একজন আমলার ছেলের বাধবে কেন? বিষয়টির জন্য কাকে দায়ী করব? পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের দশকেও এসব তো ঘটেনি।
এক সময় তিন লাখ টাকা থেকে চাকরিবাণিজ্য শুরু হয়। সেই তিন লাখ এখন ১৫ থেকে ১৮ লাখে এসে ঠেকেছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই- দুর্নীতি এখন সর্বব্যাপী। কিন্তু শিক্ষায় যে দুর্নীতিবাজ লোকটি ঘুষের প্রক্রিয়ায় শিক্ষককে চাকরি দেন; তার ছেলেটি যে দুর্নীতির শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ল- এটা কি ভাবার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই? এক সময় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা করার জন্য খুব ভালো ছাত্ররা আসত না। বেতন কম ছিল; চাকরির সুযোগ-সুবিধা ছিলই না বলতে গেলে। সরকার এসব বিবেচনায় বেতন ও অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রচুর সংখ্যক শিক্ষয়িত্রী এই পেশায় যোগ দিচ্ছেন।
তাদের এক ধরনের সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। কত নিষ্ঠুর ঘটনা যে ঘটে, তার একটার কথা না বলে পারছি না।
বাংলাদেশের প্রান্তিক শহর দিনাজপুরের এক ভদ্রলোকের দুটিই কন্যাসন্তান। বড় মেয়েটি মেধাবী ও আত্মবিশ্বাসী। ছোট মেয়েটি অত ভালো ছাত্রী নয়, আত্মবিশ্বাসের যথেষ্ট অভাব আছে। দু'জনই প্রাইমারি শিক্ষকের চাকরিপ্রার্থী। মেয়েটির বাবা আমার কাছে পরামর্শ চাইলেন। ছোট মেয়েটি যেহেতু ছাত্রী অত ভালো নয়, তাই একজন দালাল মোটামুটি ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু বড় মেয়েটির জন্য তিনি সংকটে পড়েছেন। যেহেতু মেয়েটি পড়ালেখায় ভালো, তাই দালালকে ঘুষ দেওয়ার প্রয়োজন নিয়ে তিনি দ্বিধান্বিত। কিন্তু দালাল বলেই যাচ্ছে- দুটোর জন্যই টাকা দেন। দু'জনেরই চাকরি অনিবার্য। আমি তখন পরামর্শ দিলাম, বড় মেয়েটি যখন আত্মবিশ্বাসী তখন আর চিন্তা কীসের? ওর জন্য টাকা দেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু ফলাফল দাঁড়াল- ছোট মেয়েটি চাকরি পেয়ে গেল; বড় মেয়েটি পেল না। ততদিনে বড় মেয়েটির বিয়েও হয়ে গেছে। এই শোক সহ্য করতে না পেরে নিরীহ বাবার স্ট্রোক হয়ে যায়। সম্ভবত পরে সেই বাবা মৃত্যুবরণ করেন।
এই ৪৫ হাজার চাকরির জন্য লাখ লাখ প্রার্থী ও অভিভাবকের মধ্যে কারও কারও একই ধরনের পরিণতি হয়তো হতে পারে। এ কথাও সত্যি, উচ্চ পর্যায়ের আমলাদের সন্তানরা সরকারি স্কুলে পড়ালেখা করে না। দেশের প্রাইভেট স্কুলে এবং বিদেশের কনভেন্ট স্কুলে তাদের জন্য দ্বার অবারিত। তাহলে উপায় কী? এই ৪৫ হাজার শিক্ষক নিয়োগের পর ৬৭৫০ কোটি টাকার অর্থনীতিটি শেষ হয়ে যাওয়ার পর বড় ধরনের আর কোনো সুযোগ তাদের আসছে না। বদলির তদবির, পদোন্নতি এসব করেই অর্থ সঞ্চয় করে শহরের উপকণ্ঠে পাঁচ বা ১০ কাঠার একটা প্লট হয়ে যায়। চাকরি না হলে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী, দালাল টাকা ফেরত দিয়ে দেন; তারা আবার অন্যদিক থেকেও সৎ। নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, হজে যান এবং ঘুষের টাকা পকেটে নিয়েই নামাজে বসেন। তার চেয়েও বড় কথা, ঘুষদাতাকে অপেক্ষমাণ রেখে তিনি দীর্ঘ মোনাজাতও করেন।
সাধারণ মানুষের কী করার আছে! দীর্ঘ দিন ধরে আমলাতন্ত্র ব্রিটিশ নিয়মেই চলছে। ১৮৬৫ সালের আইনে চলছে ফৌজদারি। আর আমলাতন্ত্র চলছে এরও আগের আইনে। জেলা কালেক্টরের নামটি সংশোধিতভাবে ডেপুটি কমিশনার হয়েছে বটে; কিন্তু তার চাকরিবাকরি, আরাম-আয়েশ, আইনকানুন সবই চলছে ব্রিটিশ কায়দায়। সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, জেলার শুধু দণ্ডমুণ্ডের কর্তা নন; তিনি ভয়ংকরভাবে জনবিচ্ছিন্ন এবং জনগণের কাছে তার কোনো জবাবদিহি নেই। একই অবস্থা সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের দপ্তর বা অধিদপ্তরে। এখানে দুদক বা তদন্ত এজেন্সির কিছু করার থাকে না। এবারের ৪৫ হাজার চাকরির ক্ষেত্রে একটি অন্য বিবেচনা করতে চাই। দেশে আগামী ৫০ বছরের শিক্ষার
পরিকল্পনা নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এলাকার সর্বজনস্বীকৃত শিক্ষানুরাগীদের নিয়ে এই ৪৫ হাজারকে রক্ষা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ূন। জানি, কাজটি সহজ নয়। কারণ, যারা দুর্নীতির সুযোগ নেবেন তারা দুর্নীতিবাজ আমলাদের পাশেই দাঁড়াবেন। পৃথিবীর কোথাও খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা এসব নিয়ে কোনো দুর্বল আইন নেই।
আমাদের দেশের আইন যেমন দুর্বল, তার প্রয়োগও তেমনি দুর্বল। এই ৪৫ হাজার নিয়োগের পর যেসব কর্মকর্তা ও দালাল শ্রেণি এর সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাদের ওপর একটি সৃজনশীল তল্লাশি এবং তদন্ত করা যায় কিনা, তা ভাবার প্রয়োজন আছে। কত পরিমাণ টাকা তারা ঘুষ-দুর্নীতির কাজে লেনদেন করে থাকেন, নিয়োগবাণিজ্যে মাঠ পর্যায় থেকে সঠিক তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ঘোরতর ব্যবস্থা নেওয়া খুবই প্রয়োজন। এ কাজের সঙ্গে অবশ্যই নাগরিকদের যুক্ত করতে হবে। অবশ্য সেসব নাগরিকের তালিকাই-বা কে করবে? তবে যদি দুই-একটা বড় ধরনের অভিযান করা যায় তাহলে দুর্নীতিবাজরা মুহূর্তের জন্য হলেও ঘাবড়ে যেতে বাধ্য। কালে কালে যদিও শিক্ষার দুর্নীতি বহুদূর ডালপালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তবুও দুর্নীতির এসব ডালপালা ছেঁটে দেওয়ার এখনই উৎকৃষ্ট সময়। বিলম্ব করা উচিত হবে না।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব
মন্তব্য করুন