ঢাকা শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪

সাক্ষাৎকার: নুরুল ইসলাম

আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থেই চীন ও ভারতের উচিত রোহিঙ্গাদের সাহায্য করা

আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থেই চীন ও ভারতের উচিত রোহিঙ্গাদের সাহায্য করা

--

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২২ | ১২:০০

নুরুল ইসলাম ১৯৯৮ সাল থেকে আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (এআরএনও) সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি রাখাইনের জাতীয়তাবাদী দল ন্যাশনাল ইউনাইটেড পার্টি অব আরাকানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭৮ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার আর্মির কুখ্যাত কিং ড্রাগন অপারেশনের পর তিনি রোহিঙ্গা মুক্তির আন্দোলনের শীর্ষ সারিতে চলে আসেন। তিনি রেঙ্গুন ইউনিভার্সিটি থেকে বিএ ও এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট লন্ডন থেকে এলএলএম ডিগ্রি অর্জনকারী নুরুল ইসলাম বর্তমানে ইংল্যান্ডে বাস করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশফাক আনুপ, আলতাফ পারভেজ, আশফাক রনি ও শফিকুল আলম। সমকালে এর নির্বাচিত অংশ প্রকাশিত হলো।
সমকাল: আপনার জন্ম বার্মার মংডুতে। রাজনৈতিক পথচলা কীভাবে?
নুরুল ইসলাম: শৈশব থেকেই আমি রোহিঙ্গাদের ওপর জুলুম-অত্যাচার দেখে আসছি। স্কুলজীবনেই আমার মনে হলো, এই অবিচারের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। নবম শ্রেণিতে আমি রোহিঙ্গাদের আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠন রোহিঙ্গা ইনডিপেনডেন্ট ফোর্সের সঙ্গে যুক্ত হই। মাস্টার সুলতান তখন এর নেতৃত্বে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমরা আরও সংগঠিত হয়ে রোহিঙ্গা প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট গঠন করি। বার্মার শাসকগোষ্ঠী আমাদের বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনলে বাধ্য হয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেই। বার্মার সেনাদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করি। এক পর্যায়ে বার্মায় টিকে থাকতে না পেরে বাংলাদেশ হয়ে লন্ডন আসতে বাধ্য হই।
সমকাল: আপনাদের সংগ্রাম তো অনেক পুরোনো।
নুরুল ইসলাম: আমাদের সংগ্রামটা আসলে একটি ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ। আমাদের পথিকৃৎদের আন্দোলনকে আমরা সামনের দিকে টেনে গিয়েছি।
সমকাল: পথিকৃৎ বলতে কাদের কথা বলছেন?
নুরুল ইসলাম: রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম দুটি ধারা ছিল। একটি ধারা ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীন হওয়ার পর গণতান্ত্রিক পরিবেশে সংসদীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে। আব্দুল গাফফার সাহেব ও সুলতান আহমেদ সাহেব ছিলেন এই ধারার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সাংসদ নির্বাচিত হয়ে তারা বার্মার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। আরেকটি ধারা সশস্ত্র সংগ্রামের পথকে শ্রেয় মনে করেছিল। এই ধারার নেতা ছিলেন জাফর কাওয়াল। তিনি বেশ বড় সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন।
সমকাল: ১৯৩৬ সালে জামিয়াত উল ওলামা গঠিত হওয়ার পর থেকে উত্তর আরাকানে ইসলামবাদী আন্দোলনের ট্রেন্ড লক্ষ্য করা যায়। রোহিঙ্গারা কি আরাকানে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়?
নুরুল ইসলাম: রোহিঙ্গারা কখনও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেনি। আমরা প্রথম থেকেই মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে আসছি। রোহিঙ্গাদের ওপর আন্দোলন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বার্মা স্বাধীন হওয়ার পর সরকার বিভিন্ন জাতি ও উপজাতির অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করলেও আমাদের উপেক্ষা করেছে। আমাদের একটি অংশ সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে আন্দোলন করেছে। জাফর কাওয়ালের নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলনের পথ বেছে নেওয়া অংশ নিজেদের মুজাহিদ পরিচয় দিতেন। কিন্তু তারা রোহিঙ্গাদের অধিকার ও স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছেন। ইসলাম কায়েমের জন্য নয়। রোহিঙ্গা মুজাহিদ আর ইসলাম কায়েমের জন্য যুদ্ধ করা মুজাহিদ এক নয়। এই পরিচয় নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ আমাদের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছে।
সমকাল: যদি ধর্মীয় আন্দোলন না-ই হয়, সে ক্ষেত্রে আপনারা রাখাইনদের সঙ্গে যৌথ আন্দোলনের চেষ্টা করেছে কি?
নুরুল ইসলাম: আমরা রাখাইনদের সঙ্গে যৌথ আন্দোলনের চেষ্টা করেছি। অতীতে জাফর কাওয়ালদের মুজাহিদ গ্রুপের সঙ্গে রাখাইন সশস্ত্র গ্রুপগুলোর এক ধরনের বোঝাপড়া ছিল। আমাদের আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (এআরএনও) সঙ্গে ন্যাশনাল ইউনাইটেড পার্টি অব আরাকানের (এনইউপিএ) যৌথ আন্দোলনের চুক্তি ছিল। আমি এনইউপিয়ের নেতা মেজর জেনারেল খিন রাজারের সঙ্গে এই চুক্তি করেছিলাম। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা উভয় কমিউনিটি বার্মিজদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসির ফাঁদে পা দিয়েছি। রাখাইনের বড় একটি অংশ রোহিঙ্গাদের সমান অধিকার ও মর্যাদায় সহাবস্থান চায় না।
সমকাল: এই বাস্তবতায় রাখাইনদের সঙ্গে আপনারা সহাবস্থান নিশ্চিত করবেন কীভাবে?
নুরুল ইসলাম: দেখুন, অতীতে রাখাইন ও রোহিঙ্গারা একসঙ্গে আরাকান রাজ্য গঠন ও এর সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছি। অতীতে সহাবস্থান সম্ভব হলে এখনও সম্ভব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমাদের মধ্যে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা বার্মিজ রাজনীতিবিদরা নিজেদের স্বার্থে জিইয়ে রেখেছে। কিছু সংখ্যক রাখাইন বার্মিজদের ফাঁদে পা দিয়ে রোহিঙ্গামুক্ত আরাকান গড়ার স্বপ্ন দেখছে। এসব আত্মঘাতী চিন্তা থেকে তাদের সরে আসতে হবে। তারা যদি রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে না পারে, সে ক্ষেত্রে আমরা যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে আলাদা থাকতে পারি।
সমকাল: বার্মার সরকারের পক্ষ থেকে যখনই রাখাইনে চালানো নিপীড়নগুলোকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তখন তারা রোহিঙ্গা গোষ্ঠীকে 'অবৈধ বাঙালি' বলে আখ্যায়িত করেছে। তারা ধর্মীয় গোষ্ঠী নাকি নৃগোষ্ঠী হিসেবে দেখছে?
নুরুল ইসলাম: তাদের কাছে আমরা প্রথমে বাঙালি, তারপর মুসলিম। বাঙালিদের প্রতি তাদের ঐতিহাসিকভাবে প্রবল ঘৃণা আছে। ঐতিহাসিকভাবে বলছি এ কারণে, আদি থেকে বর্মিদের সঙ্গে স্বাধীন আরাকানের শত্রুতা ছিল। যখনই বর্মিরা আরাকানে হামলা করত, আরাকানের রাজপরিবার ও অভিজাতরা বাংলাতেই আশ্রয় নিত। বাংলাও আরাকানিদের হারানো রাজ্য পুনরায় ফিরে পেতে সাহায্য করেছে। বর্মিদের বাঙালি বিদ্বেষ তখন থেকেই। আবার এটাও ঠিক, বর্মিরা রোহিঙ্গাদের প্রতি ঘৃণা ছড়াতে ধর্মকে ব্যবহার করেছে। নতুন প্রজন্মের রাখাইনদের মধ্যেও এই বিশ্বাসটা ঢুকে গেছে, রোহিঙ্গারা সবাই বাঙালি।
সমকাল: আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোতে আমরা দেখি রোহিঙ্গা 'মুসলিম' কথাটা বারবার উঠে আসছে। রোহিঙ্গাদের নিজস্ব ধর্মনিরপেক্ষ নৃতাত্ত্বিক জাতিগত পরিচয় তৈরি হয়েছে কিনা?
নুরুল ইসলাম: রোহিঙ্গাদের মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ আছে। অল্পসংখ্যক খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষও আছে। আমাদের ধর্মভিত্তিক নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী বলা যাবে না। ব্যাপার হচ্ছে, রোহিঙ্গার বড় একটা অংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের। এ কারণেই হয়তো আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোতে 'রোহিঙ্গা মুসলিম' কথাটা উঠে আসে।
সমকাল: রাখাইনদের বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত দল আরাকান আর্মি অথবা ইউএলএ বারবার বলার চেষ্টা করে, তারা রোহিঙ্গা পরিচয় নিয়ে যে লড়াই করছে এটা আমরা মেনে নিতে পারি না। কিন্তু তারা যদি বাঙালি পরিচয় দেয়, বাঙালি হিসেবেই থাকতে পারবে।
নুরুল ইসলাম: আমাদের আত্মপরিচয় নির্ধারণ করার অধিকার আছে। এটা আমাদের মানবাধিকার। আমাদের আত্মপরিচয় কী হবে সেটা তারা নির্ধারণ করতে পারে না। আমাদের পরিচয় নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলছে, তারা আমাদের জাতিগত অধিকার দিতে চায় না। আমাদের সঙ্গে তারা আরাকানের ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে চায় না।
সমকাল: রোহিঙ্গাদের সংগ্রামের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারার ঐক্যের সম্ভাবনা কতখানি?
নুরুল ইসলাম: রোহিঙ্গাদের আন্দোলনে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে আছি। আশার বিষয় হচ্ছে, আমরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে থাকলেও একটা বিষয়ে আমাদের সবার লক্ষ্য এক- আমরা সবাই রোহিঙ্গা জাতিকে মুক্তি এনে দিতে চাই। বার্মিজ যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে নিজেদের অধিকার এবং স্বাধীনতা চাই। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এমন কোনো কর্মপদ্ধতি নির্ধারিত হয়নি। সে কারণে যে যার মতো করে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা নিজেদের মধ্যে নিয়মিত আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।
সমকাল: এদের মধ্যে কাদের আমরা আসলে মূলধারা বলতে পারি?
নুরুল ইসলাম: আরনো প্রবাসীভিত্তিক একটি সংগঠন। ১৯৯৮-এর মাঝে যতগুলো সংগঠন ছিল সবাই একত্র হয়ে এটি সৃষ্টি হয়েছিল। আরএসও একটা সশস্ত্র দল নিয়ে তাদের কার্যক্রম করছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেই। আর, আরসাকে গ্রহণ করা আমাদের জন্য খুব কঠিন। এদের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আমরা দেখি না। তারা আমাদের জনমানুষের ওপরই একটা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা আমাদের নিজেদের জনমানুষের ওপরই নিপীড়ন চালাচ্ছে। মানে, মানুষ বিপদে পড়ছে এই আরসার জন্যই। তবুও আমরা এখন চিন্তা করছি একটা সনদ তৈরি করা যায় কিনা। রোহিঙ্গা জাতীয় সনদ। এই সনদের মাঝে সবাইকে এনে একত্র করব, এখন জোটের ভেতরে বা বাইরে যে যেখানেই সংগ্রাম করছে, সবাই এই সনদকে গ্রহণ করবে।
সমকাল: ২০১৭ সালে আরসার কর্মকাণ্ডেই বাংলাদেশে ১০ লাখ লোক ঢুকে পড়ল। এটা কি কোনো অন্তর্ঘাত বা ফলস ফ্ল্যাগ?
নুরুল ইসলাম: আরসার কর্মকাণ্ড বার্মার সরকারের কূটনীতিকে সহায়তা করে। বিশেষ করে, শরণার্থী সমস্যা যেটা হয়েছে, আমাদের জনমানুষ যে বিতাড়িত হলো আমাদের স্বদেশ থেকে এই জায়গায় আরসাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বার্মিজ সরকারের কূটনৈতিক চেষ্টায় বসানো হয়েছে। বার্মার সরকার এবং আরসা একই পথে হাঁটছে।
সমকাল: আপনারা কি আরএসওর সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী?
নুরুল ইসলাম: দেখুন আমরা চিন্তাভাবনা করছি। বা যা করতে চাচ্ছি, একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য করতে চাচ্ছি। প্রধানত একটা রাজনৈতিক আন্দোলন হওয়া দরকার। আপনি সশস্ত্র সংগ্রাম বলেন, যা কিছু করেন। এই সবকিছু একটা রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে থাকা উচিত। রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাঝে তারা যদি আসে তার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। তারা যদি আসে সেটাও কার্যকরী হবে। কেন নয়?
সমকাল: আপনারা আরাকান আর্মির সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী কিনা?
নুরুল ইসলাম: আমরা এরই মধ্যে তাদের প্রস্তাবনা দিয়েছি একসঙ্গে কাজ করার। তাও বহু আগে। কিন্তু তারা আজও আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের কোনো উত্তর জানায়নি। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, তাদের আমাদের জাতিপরিচয়কে মেনে নিতে হবে। তারা যদি আমাদের পরিচয়কে না মেনে নেয়, তারা যদি নিছক এটাই চায় আমরা তাদের দয়ায় বেঁচে থাকব, তাহলে এটা আমরা মেনে নিতে পারব না।
সমকাল: তার মানে আপনাদের মধ্যে একটা আস্থার ঘাটতি আছে? কীভাবে এই আস্থা নির্মাণ করা যায়?
নুরুল ইসলাম: আস্থা নির্মাণ করতে আমাদের ফিরে চাইতে হবে ইতিহাসের দিকে। আমরা কীভাবে স্বাধীন সার্বভৌম আরাকানকে রক্ষা করেছিলাম। কীভাবে করেছিলাম, আমরা সেটা দেখি। আমরা একসময় একসঙ্গেই ছিলাম তো। যখন আরাকানের রাজা, প্রধানমন্ত্রীরা ছিল মুসলমান, সেনাপতিরাও ছিল মুসলমান। আরাকানের প্রশাসনিক ক্ষমতা ছিল মুসলমানদের হাতে। এটা তো অস্বীকার করা সম্ভব না। এই ধারাকে ধ্বংস করা হয়েছিল। তো আমরা সেই ঐতিহাসিক ধারাকে আবার ফিরিয়ে আনি। তাহলেই হয়ে যাবে।
সমকাল: আপনাদের সঙ্গে কি এনইউজির যোগাযোগ হয়েছে ইতোমধ্যে?
নুরুল ইসলাম :তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ, নিয়মিত সংলাপ হয়। কিন্তু আমরা যে জিনিসগুলোতে জোর দিচ্ছি সেগুলোতে তারা কোনো জবাব দেয়নি। তারা এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে।
সমকাল: এই ভেদটা কোথায় এটা আরেকটু বলবেন?
নুরুল ইসলাম: বার্মার মানুষরা এখন মনে করে, সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। এই জায়গায় সবাই একমত। সবাই একজোট হয়ে এই লড়াইকে সমর্থন করে। কিন্তু বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে আবার বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ আছে। এদের নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন অঞ্চল আছে। এদের অনেক শর্ত থাকে, যেমন- তাদের অঞ্চলে বাকিদের তাদের কথামতো চলতে হবে ইত্যাদি। এনইউজি চাচ্ছে তাদের নিয়ন্ত্রণে এবং শাসনে অন্যদের আসতে হবে। তবে এনইউজির সংবেদনশীল রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে। তারা বলেছে, রোহিঙ্গাদের তারা নাগরিক হিসেবে মেনে নেবে। কিন্তু এ পর্যন্ত বেশকিছু ব্যাপার রয়ে গেছে। যেমন, আন্তর্জাতিক ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং মিশনের রিপোর্টটা তারা মেনে নেয়নি। মানবো নাও বলেনি, মেনে নিয়েছিও বলেনি। প্রথমত এই হলো ব্যাপার। দ্বিতীয়ত, আমরা তাদের বলেছি অং সান সু চি আইসিজেতে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেটা আপনারা প্রত্যাহার করুন এবং আপনাদের এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকারবিরোধী অপরাধ ঘটছে। আমরা বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তারা এটা মানেনি।
সমকাল: কাচিন আর্মি, ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি এরা বেশ ক্ষমতাশালী। নৃতাত্ত্বিক বিদ্রোহীগুলোর একটা জোট আছে, যেমন নর্দান অ্যালায়েন্স আছে। তাদের সঙ্গে আপনাদের কখনও যোগাযোগ হয়েছে কিনা বা আপনার কি মনে হয়, তাদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে পারবেন?
নুরুল ইসলাম: একসময় তাদের সঙ্গে কাজ করেছিলাম আমরা। কাচিনদের সঙ্গে করেছি, কারেনদের সঙ্গে কাজ করেছি। তারপর রাখাইনদের সঙ্গেও কাজ করেছি। এখন তো অনেক উত্থান-পতন ঘটে গেছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে। তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না আমাদের। আসলে সমস্যা হচ্ছে, আমাদের শক্তিমত্তার পতন ঘটেছে। আমাদের গুরুত্ব দেওয়ার মতো তারা যথেষ্ট শক্তিশালী ভাবছে না। আমরা নিজেদের সামরিক জায়গায় যথেষ্ট উন্নতি করতে পারিনি। সে ক্ষেত্রে সম্ভবত সংখ্যাটাও একটা বড় ব্যাপার। যেহেতু দেশের ভেতরেই রোহিঙ্গারা খুব বেশি সংখ্যায় থাকছেও না, সে ক্ষেত্রে সংখ্যার বিচারেও গুরুত্ব সম্ভবত কমেছে বেশ খানিকটা।
সমকাল: আরাকান আর্মি অনেক ভালোভাবে দরকষাকষি করতে পারছে বার্মার আর্মির সঙ্গে। কিন্তু আপনারা সেটা পারছেন না। আপনাদের ৮০ ভাগ জনমানুষকে ওরা দেশ থেকেই বের করে দিয়েছে। এই দুটি গোষ্ঠীর সংগ্রামই ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু। আপনাদের দুর্বলতাটা আপনি কীভাবে বিশ্নেষণ করেন?
নুরুল ইসলাম: দেখুন, আরাকান আর্মিকে পরিস্থিতি আনুকূল্য দিয়েছে। তারা প্রশিক্ষিত হয়েছে এবং নিজেদের উন্নত করেছে কাচিন অঞ্চলগুলোতে। কাচিনরা তাদের সাহায্য করেছে। তারপর তারা চীন বা চীনের মাঝখানে কোনো গোষ্ঠী থেকে সহায়তা পেয়েছে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমাদের সংগ্রামে বাংলাদেশ প্রভাবক গোষ্ঠী। দশকের পর দশক ধরে রোহিঙ্গা সমস্যার মূল ভারবহন করে আসছে। এজন্য আপনাদের নিজেদের স্বার্থেই এবং রোহিঙ্গাদের স্বার্থে আপনাদেরই এ রকম একটা কিছু চিন্তা করার দরকার আছে, যাতে আমরা নিজেদের উন্নতি ঘটাতে পারি।
সমকাল: আপনি কি মনে করেন এই সশস্ত্র সংগ্রামটা ঠিক আছে। এখানে তো অন্য উপায়েও সংগ্রাম হতে পারত যেমন, অহিংস একটা আন্দোলনও হতে পারত।
নুরুল ইসলাম: বার্মার অবস্থাটা তো আপনি পুরোপুরি জানেন। বার্মার মধ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বলতে কিছু নেই। আসলে আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধান করা, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক একটা সমাধান চাই আমরা। শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের জন্য একসঙ্গে বসার মতো একটা সুবিধা আমাদের দিতে হবে তো। এই নিপীড়কদের অবশ্যই আমাদের সঙ্গে বসতে হবে এবং তাদের আমাদের কণ্ঠ শুনতে হবে। এ রকম কোনো সুযোগ তারা আমাদের দিচ্ছে না। আর বার্মার মাঝে যে কোনো অত্যাচার ও নিপীড়ন রোহিঙ্গাদের ওপর হলে কোনো সামরিক বাহিনীর সদস্য বা কর্মকর্তাকে জবাবদিহি করতে হয় না আইন এবং সংবিধানের কাছে। যত জুলুম ও অত্যাচার করতে পারবে রোহিঙ্গাদের, তত সে প্রশংসিত হয়। তো এই অবস্থার মধ্যে আপনার গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন তো কোনো দিন হতেও পারে?
সমকাল: আন্তর্জাতিক আইন আপনাদের এই সশস্ত্র সংগ্রামকে অনুমোদন দেয়?
নুরুল ইসলাম: আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এটা ন্যায়সংগত। আপনি জানেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রের প্রস্তাবনায় কী লেখা আছে? যদি আর কোনো উপায় বাকি না থাকে আপনার স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম অবশ্যই ন্যায়সংগত। এটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে আছে। দ্বিতীয়ত, একটা দেশে যদি কোনো সরকার থাকে, সেই সরকারের দায়িত্ব থাকে জনগণের মানবাধিকার এবং স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। এই সরকার কখনও সেটা করবে না। বরং এই সরকার নিজেই নিপীড়কের ভূমিকা পালন করছে। তো এখন কী করা উচিত? এখন তবে এই জনমানুষদের রক্ষা করতেই 'রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্ট' ধারণায় যেতে হবে। ২০০৫ সালে এই ধারণাতে আন্তর্জাতিক মহল একমত হয়েছিল। এ ধারণাটি রোহিঙ্গাদের বেলায় প্রযোজ্য, যেহেতু আমরা ৮০ ভাগ মানুষ দেশের বাইরে আছি, আর যারা আছে দেশের ভেতর, তারা মানবেতর অবস্থায় আছে। খাবার নেই, লেখাপড়া নেই, কিছু নেই। এটা পশুর চেয়ে খারাপ অবস্থা। পশুরাও একটা জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চারণ করতে পারে। তাদের এক চারণভূমি থেকে আরেক চারণভূমিতে যাওয়ার স্বাধীনতা আছে। কিন্তু আমাদের লোকজন এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যেতে পারে না।
সমকাল: আরাকানে চীনের একটা বিশাল বিনিয়োগ আছে। তারা প্রায় সময়ই বলে রোহিঙ্গাদের ফেরত চায় ইত্যাদি। চীন রোহিঙ্গাদের কোনো ধরনের সাহায্য করবে কিনা?
নুরুল ইসলাম: তাদের আমাদের সাহায্য করা উচিত। কারণ হচ্ছে, তারা আঞ্চলিক শক্তি। ভারতও, চীনও। তারপর তাদের উভয়েরই আরাকানে কিছু স্বার্থ আছে। আমরা এখানকার একটি স্টেকহোল্ডার অনেক স্টেকহোল্ডারের মধ্যে। যে কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, অর্থনৈতিক বা অন্যান্য বিনিয়োগ তারা যদি আরাকানের ভেতর করে, আমাদের কোনো বিরোধ নেই তাতে। কিন্তু সেটা করতে অবশ্যই স্টেকহোল্ডারদের অবহিত করে সম্মতি নিতে হবে। শুধু রাখাইনদের থেকে নিলে হবে না, রোহিঙ্গাদের থেকেও নিতে হবে। আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থেই চীন ও ভারতের উচিত রোহিঙ্গাদের সাহায্য করা।
সমকাল: রোহিঙ্গাদের প্রবাসী অংশ উচ্চশিক্ষিত হচ্ছে। নতুন প্রজন্ম আপনাদের সংগ্রামকে কতটুকু এগিয়ে নিয়ে যাবে?
নুরুল ইসলাম: এখন যারা প্রবাসে আছে তারা যে অবদানটা দেবে, আর যারা দেশের ভেতরে আছে তাদের অবদানে পার্থক্য থাকবে। আমাদের মূল সম্পদ হচ্ছে যারা দেশের ভেতরে আছে তারা অথবা যারা শরণার্থী শিবিরে আছে এই আশায়, তারা একসময় নিজ মাতৃভূমিতে ফিরবে। তারা খুব বেশি করে অনুভব করে, তাদের আর কোনো আশ্রয়ের জায়গা নেই এবং তাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে তাদের মাতৃভূমিতে, তাদের জীবন আবার তৈরি করতে। বাংলাদেশ সরকারকে আমরা অনুরোধ করব, দয়া করে শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের মানসম্মত শিক্ষা দিন, যাতে তারা নিজেদের ভেতর মানবিক গুণগুলো তৈরি করতে পারে। তাহলে যখন তারা ফিরতে পারবে, তখন তারা সমাজ নির্মাণে কার্যকর হবে। আরেকটা ব্যাপার, আমাদের তরুণদের বুঝতে হবে তাদের অধিকার কেউ দিয়ে দেবে না। এটার জন্য লড়াই করতে হবে। তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে তাদের।

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×