
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দা পাহাড়ি জনগোষ্ঠী খুবই আমোদ; উৎসব ও মেলাপ্রিয়। কোনো উৎসব বা মেলা যদি একবার আরম্ভ করা যায়, তা আর সহজে শেষ হয় না। এদের জীবনে উৎসব বা মেলার আরম্ভকাল অতি প্রাচীন। বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি, কিংবদন্তি তেমনই নির্দেশ করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে থিতু হওয়ার পর তাদের জীবিকা বন ও পাহাড়কেন্দ্রিক হলেও ব্রিটিশ যুগে চট্টগ্রামের রাউজানের পাহাড়তলীতে মং চিফের আদি পুরুষ কংজয় দবইং কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মহামুনি বৌদ্ধমেলায় বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ দলে দলে যোগদান করত। তখন প্রতি বছর বিষুব সংক্রান্তি উপলক্ষে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ১৫-২০ দিনব্যাপী সেখানে বৌদ্ধমেলা বসত। পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন সুপারিনটেনডেন্ট ক্যাপ্টেন লুইনও ওই মেলায় দু-একবার অংশ নেন বলে জানা যায়। তিনি সেখানে প্রচুর মারমা, চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের স্বতঃস্ম্ফূর্ত নরনারীর অংশগ্রহণ দেখেন।
বৌদ্ধরা ওই সময় বুদ্ধ-বন্দনার পর যথারীতি ভিক্ষুসীমা প্রদক্ষিণ করে। সাধারণত ডান থেকে বাম দিকে ঘোরা হয়। দলে কেউ বাঁশি বাজায়, কেউ রেং কাটে (পাহাড়িদের উৎসবি-চিৎকার)। একবার নাকি একই সময়ে মারমারা ডান দিক থেকে ও চাকমারা বাম দিক থেকে ভিক্ষুসীমা প্রদক্ষিণ করে। এ নিয়ে দু'দলের মধ্যে চেঁচামেচি-তর্কাতর্কি লেগে গেলে মারামারির ঘটনা ঘটে। মারমারা দলে ভারি হওয়ায় চাকমারা পিছু হটে যায়। তারা মনোকষ্টে রাঙ্গুনিয়ার রাজানগরে ফিরে যায় এবং চাকমাপ্রধান কালিন্দী রানীকে ঘটনাটি জানায়। তারা রাজানগরে নতুন একটি মহামুনি স্থাপন করতে আর্জি জানায়। তখন রানী বার্মার মাণ্ডালয় থেকে ভদন্ত সারমেধ ভিক্ষুকে এনে চৈত্রসংক্রান্তিতে নতুন একটি মহামুনি মেলার গোড়াপত্তন করেন। তিনি সব সম্প্রদায়ের জন্য ওই মেলা উন্মুক্ত করে দেন। সেখানে গাজন বা চড়ক উৎসবও অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও ধুমধাম আকারে উভয় বৌদ্ধমেলার উৎসবে প্রচুর পাহাড়ির আগমন ঘটে। এ লেখকও কৈশোর ও যৌবনে বহুবার ওই মেলায় অংশ নিয়েছেন। রাজানগরের বৌদ্ধমেলায় চড়ক পূজায় অংশগ্রহণকারীর পিঠে রক্তপাতের স্মৃতি এখনও মনে গেঁথে আছে। পাহাড়ি গ্রামের প্রতিটি ঘর থেকে অন্তত একজন তীর্থের নামে মেলায় না গেলে যেন অমর্যাদা হয়। অনেক জুম চাষি কষ্ট করে অর্থ জমায় ও তীর্থের কাকের মতো আসন্ন মেলার প্রতীক্ষায় থাকে। বিষুব সংক্রান্তি উপলক্ষে মারমারা সাংগ্রাই নামে, চাকমারা বিঝু নামে, ত্রিপুরারা বৈসু নামে ও অন্যরা অন্য নামে এ উৎসব পালন করে। পাহাড়িদের জীবন-জীবিকায় বহু ধরনের বাধা-বিপত্তি হাজির হয়েছে। জমিজমা হারিয়ে দরিদ্রতার মুখে পড়েছে। কিন্তু উৎসব পালনের বেলায় আগের ধারা পরিত্যাগ করেনি।
তবে পাহাড়িরা উৎসবের মূল জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে। তাদের থিম হলো সাফল্য-ব্যর্থতাকে আনন্দের মধ্য দিয়ে বিদায় জানানো। কিন্তু তারা এখন র্যালির আয়োজন করে। যার পেছনে এমনকি দুই-তিন লাখ টাকা করে খরচ করা হয়। সমাজের চোখে এগুলো অপব্যয়। এর সঙ্গে ঐতিহ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী কৃষ্টিগুলো চর্চার পরিবর্তে অপরের কৃষ্টিকে তুলে ধরতে দেখা যায়।
এখন সময় হয়েছে পাহাড়িদের সীমাহীন আমোদ, উৎসব, মেলার আয়োজনের ক্ষেত্র কমাতে। এমন অপব্যয় করতে করতে জাতি ফতুর হতে চলেছে। যেখানে অস্তিত্ব রক্ষা, অর্থনৈতিক সচ্ছলতার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে, সেখানে এমন এলাহি আয়োজন গরিবের ঘোড়ারোগ ছাড়া আর কী? পাহাড়িরা কোনো ব্যবসাপাতি জানে না। কারিগরি ও শ্রমসাধ্য কাজ জানে না। কৃষি, মজুর খাটা, চাকরি ছাড়া তাদের আর কোনো দৃশ্যমান পেশা নেই। এমন দুরবস্থার মধ্যে উৎসবে গা ভাসিয়ে দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? এ অবস্থায় বলা যায়, পাহাড়িদের 'পুনৎ নাই তেনা, মিধাদি ভাত খানা' (চট্টগ্রামি) অথবা 'কো ক্রিগে ছাংরিসা :চাফো ক্রিরে লাক্ষোসা:' (মারমা গান)। এগুলোর ভাবার্থ :পরনে কাপড় পর্যন্ত নাই, তবু বড়লোকি দেখাই। অথচ তাদের কঠিন দিন এসেছে। তাই এখনই পাহাড়িদের উৎসবের রাশ টেনে ধরা উচিত।
অংসুই মারমা: সাবেক ফিল্ড সুপারিনটেনডেন্ট, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড
পার্বত্য চট্টগ্রামে থিতু হওয়ার পর তাদের জীবিকা বন ও পাহাড়কেন্দ্রিক হলেও ব্রিটিশ যুগে চট্টগ্রামের রাউজানের পাহাড়তলীতে মং চিফের আদি পুরুষ কংজয় দবইং কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মহামুনি বৌদ্ধমেলায় বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ দলে দলে যোগদান করত। তখন প্রতি বছর বিষুব সংক্রান্তি উপলক্ষে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ১৫-২০ দিনব্যাপী সেখানে বৌদ্ধমেলা বসত। পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন সুপারিনটেনডেন্ট ক্যাপ্টেন লুইনও ওই মেলায় দু-একবার অংশ নেন বলে জানা যায়। তিনি সেখানে প্রচুর মারমা, চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের স্বতঃস্ম্ফূর্ত নরনারীর অংশগ্রহণ দেখেন।
বৌদ্ধরা ওই সময় বুদ্ধ-বন্দনার পর যথারীতি ভিক্ষুসীমা প্রদক্ষিণ করে। সাধারণত ডান থেকে বাম দিকে ঘোরা হয়। দলে কেউ বাঁশি বাজায়, কেউ রেং কাটে (পাহাড়িদের উৎসবি-চিৎকার)। একবার নাকি একই সময়ে মারমারা ডান দিক থেকে ও চাকমারা বাম দিক থেকে ভিক্ষুসীমা প্রদক্ষিণ করে। এ নিয়ে দু'দলের মধ্যে চেঁচামেচি-তর্কাতর্কি লেগে গেলে মারামারির ঘটনা ঘটে। মারমারা দলে ভারি হওয়ায় চাকমারা পিছু হটে যায়। তারা মনোকষ্টে রাঙ্গুনিয়ার রাজানগরে ফিরে যায় এবং চাকমাপ্রধান কালিন্দী রানীকে ঘটনাটি জানায়। তারা রাজানগরে নতুন একটি মহামুনি স্থাপন করতে আর্জি জানায়। তখন রানী বার্মার মাণ্ডালয় থেকে ভদন্ত সারমেধ ভিক্ষুকে এনে চৈত্রসংক্রান্তিতে নতুন একটি মহামুনি মেলার গোড়াপত্তন করেন। তিনি সব সম্প্রদায়ের জন্য ওই মেলা উন্মুক্ত করে দেন। সেখানে গাজন বা চড়ক উৎসবও অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও ধুমধাম আকারে উভয় বৌদ্ধমেলার উৎসবে প্রচুর পাহাড়ির আগমন ঘটে। এ লেখকও কৈশোর ও যৌবনে বহুবার ওই মেলায় অংশ নিয়েছেন। রাজানগরের বৌদ্ধমেলায় চড়ক পূজায় অংশগ্রহণকারীর পিঠে রক্তপাতের স্মৃতি এখনও মনে গেঁথে আছে। পাহাড়ি গ্রামের প্রতিটি ঘর থেকে অন্তত একজন তীর্থের নামে মেলায় না গেলে যেন অমর্যাদা হয়। অনেক জুম চাষি কষ্ট করে অর্থ জমায় ও তীর্থের কাকের মতো আসন্ন মেলার প্রতীক্ষায় থাকে। বিষুব সংক্রান্তি উপলক্ষে মারমারা সাংগ্রাই নামে, চাকমারা বিঝু নামে, ত্রিপুরারা বৈসু নামে ও অন্যরা অন্য নামে এ উৎসব পালন করে। পাহাড়িদের জীবন-জীবিকায় বহু ধরনের বাধা-বিপত্তি হাজির হয়েছে। জমিজমা হারিয়ে দরিদ্রতার মুখে পড়েছে। কিন্তু উৎসব পালনের বেলায় আগের ধারা পরিত্যাগ করেনি।
তবে পাহাড়িরা উৎসবের মূল জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে। তাদের থিম হলো সাফল্য-ব্যর্থতাকে আনন্দের মধ্য দিয়ে বিদায় জানানো। কিন্তু তারা এখন র্যালির আয়োজন করে। যার পেছনে এমনকি দুই-তিন লাখ টাকা করে খরচ করা হয়। সমাজের চোখে এগুলো অপব্যয়। এর সঙ্গে ঐতিহ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী কৃষ্টিগুলো চর্চার পরিবর্তে অপরের কৃষ্টিকে তুলে ধরতে দেখা যায়।
এখন সময় হয়েছে পাহাড়িদের সীমাহীন আমোদ, উৎসব, মেলার আয়োজনের ক্ষেত্র কমাতে। এমন অপব্যয় করতে করতে জাতি ফতুর হতে চলেছে। যেখানে অস্তিত্ব রক্ষা, অর্থনৈতিক সচ্ছলতার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে, সেখানে এমন এলাহি আয়োজন গরিবের ঘোড়ারোগ ছাড়া আর কী? পাহাড়িরা কোনো ব্যবসাপাতি জানে না। কারিগরি ও শ্রমসাধ্য কাজ জানে না। কৃষি, মজুর খাটা, চাকরি ছাড়া তাদের আর কোনো দৃশ্যমান পেশা নেই। এমন দুরবস্থার মধ্যে উৎসবে গা ভাসিয়ে দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? এ অবস্থায় বলা যায়, পাহাড়িদের 'পুনৎ নাই তেনা, মিধাদি ভাত খানা' (চট্টগ্রামি) অথবা 'কো ক্রিগে ছাংরিসা :চাফো ক্রিরে লাক্ষোসা:' (মারমা গান)। এগুলোর ভাবার্থ :পরনে কাপড় পর্যন্ত নাই, তবু বড়লোকি দেখাই। অথচ তাদের কঠিন দিন এসেছে। তাই এখনই পাহাড়িদের উৎসবের রাশ টেনে ধরা উচিত।
অংসুই মারমা: সাবেক ফিল্ড সুপারিনটেনডেন্ট, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড
মন্তব্য করুন