
বাংলাদেশে মটরশুঁটি খুব পরিচিত এবং জনপ্রিয় একটি সবজি। এটি অত্যন্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যপণ্য। মটরশুঁটিই পরিপকস্ফ হলে মটর ডালে পরিণত হয়। মটরশুঁটিতে প্রচুর ফলিক অ্যাসিড আছে। এটি ভিটামিন সি বা এসকরবিক অ্যাসিডের অন্যতম উৎস, যা মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মটরশুঁটিতে যথেষ্ট পরিমাণ ভিটামিন এ, ভিটামিন কে, ম্যাঙ্গানিজ, থায়ামিন, আয়রন এবং ফসফরাস রয়েছে। হাড় এবং মাংসপেশির দৃঢ়তার জন্য মটরশুঁটি অত্যন্ত উপযোগী, বিশেষ করে আর্থ্রাইটিস ও অস্টিওপোরোসিস রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। মটরশুঁটি বার্ধক্যের লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। ওজন কমানোসহ নানা রোগ প্রতিরোধে মটরশুঁটি খুব কার্যকর।
মটরশুঁটি শীতকালীন ফসল। বাংলাদেশে শীত মৌসুমে এই ফসলের জন্য অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করে বিধায় শীত মৌসুমে এর চাষাবাদ হয়ে থাকে। ফসল ১০ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার মধ্যে ভালো ফলন দেয়। এ জন্য বাংলাদেশে মটরশুঁটির বীজ বপনের সবচেয়ে ভালো সময় নভেম্বর মাস। তবে নভেম্বর মাসে জমিতে আমন ধান থাকে। সে জন্য কৃষকরা আমন ধান থাকাকালেই জমি কাদা কাদা থাকা অবস্থায় বিঘাপ্রতি ২০-২৫ কেজি মটরশুঁটির বীজ জমিতে ছিটিয়ে দেন। একে রিলে ফসল চাষ পদ্ধতি বলা হয়। মটরশুঁটি বীজ বোনার ২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে কৃষক পাকা আমন ধান কেটে নেওয়ার পর জমিতে ছোট ছোট মটরশুঁটির চারা দেখা দেয়। ধান কাটার পর মটরশুঁটির চারা রোদ-বাতাস পেয়ে দ্রুত বেড়ে ওঠে। বিগত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, জলবায়ুর মাত্রাতিরিক্ত পরিবর্তনজনিত কারণে বিশেষ করে অসময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে মটরশুঁটির জমিতে কয়েক দিনের জন্য জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। মূলত বৃষ্টির পানি নিস্কাশন না করার কারণে প্রায় প্রতিবছর মটরশুঁটি ফসল নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে কৃষক মটরশুঁটিসহ অন্যান্য ফসল চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে শুস্ক মৌসুমে উপকূলের অনাবাদি জমি আবাদের আওতায় আনতে অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের যৌথ প্রকল্পের আওতায় অস্ট্রেলিয়ার এসিআইএআর এবং বাংলাদেশের কেজিএফের অর্থায়নে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া, সিএসআইআরও, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৭ সাল থেকে গবেষণা করে আসছে।
যেহেতু সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে শুস্ক মৌসুমে বা শীতকালে বিস্তীর্ণ জমি পতিত থাকে, সে কারণে এ অঞ্চলে এ খাদ্যপণ্য চাষের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কয়েক বছরের গবেষণার ভিত্তিতে শুস্ক মৌসুমে উপকূলের অনাবাদি জমিতে ডাল ও গমের উন্নত চাষাবাদের জন্য এই যৌথ প্রকল্প পভার্টি ইরাডিকেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে ব্লক প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বারি মটর-৩ উচ্চফলনশীল একটি মটরশুঁটির জাত। এটি চাষাবাদে ভালো ফলন পাওয়া যেতে পারে। এটি তুলনামূলক কিছুটা জলাবদ্ধতা-সহনীয়। কৃষক মটরশুঁটি বীজ বোনার ৬৫-৭৫ দিনের মধ্যেই তা তুলতে, খেতে এবং বাজারে বিক্রি করতে পারবেন। গবেষণায় দেখা গেছে, ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে ধান কাটার সময় উপকূলের জমিতে সাধারণত লবণাক্ততা কম থাকে। ফেব্রুয়ারির পর তা বেড়ে যায়। নভেম্বর মাসে মটরশুঁটি বীজ বপন করলে মার্চ মাসেই অর্থাৎ লবণাক্ততা বাড়ার আগেই তা ঘরে তোলা যায়।
বাজারে এখন এক কেজি মটরশুঁটির মূল্য ৫০ থেকে ৭০ টাকা। অথচ ধানের জমিতে রিলে পদ্ধতিতে মটরশুঁটি চাষাবাদে বীজ, সারসহ খরচ বিঘাপ্রতি মাত্র এক হাজার টাকা। শুধু তাই নয়; মটরশুঁটি গাছের শিকড়ে নডুউল তৈরি হয়, যা মাটিকে উর্বর করে। এই ডাল ফসল আবাদের কারণে জমির উর্বরতা শক্তিও বাড়ে। উপকূলে মটরশুঁটি আবাদে বিবেচনায় রাখতে হবে- ১. পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা ছাড়া মটরশুঁটি চাষাবাদ ঠিক হবে না। ২. ধান কাটার ২০-২৫ দিন আগে কর্দমাক্ত বা ভেজা জমিতে মটরশুঁটির বীজ ছিটাতে হবে। ৩. বীজ ছিটানোর সময় ধান গাছ দাঁড়ানো অবস্থায় থাকতে হবে। ধান গাছ মাটিতে শুয়ে পড়লে ওই জমিতে মটরশুঁটি চাষাবাদ করা যাবে না। ৪. ধান কাটার সময় জমিতে ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি পরিমাণ নাড়া রেখে ধান কাটতে হবে। এতে মটরশুঁটি গাছ ধান গাছের নাড়াকে অবলম্বন করে বাউনির সাহায্যে ওপরে উঠতে পারে, যা অধিক ফলনে সহায়ক। ৫. ধানের জমিতে মটরশুঁটি বীজ ছিটানোর এক দিন আগে বিঘাপ্রতি সাড়ে সাত কেজি টিএসপি, সাড়ে চার কেজি পটাশ এবং সাড়ে চার কেজি জিপসাম ছিটিয়ে দিলে ফলন ভালো হবে। ৬. ধান কাটার পর মটরশুঁটি রিলে জমিতে বিকেলের দিকে বিঘাপ্রতি ৮ কেজি ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দিলে ফলন ভালো হবে। খেয়াল রাখতে হবে, এ সময় জমি যেন ভেজা ভেজা থাকে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউট বেশকিছু স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে, যেগুলো ভালো ফলন দিতে সক্ষম। আবার বেশকিছু জাত উদ্ভাবন হয়েছে, যেগুলো পাকার সময় ধান গাছ দাঁড়ানো অবস্থায় থাকে। লবণসহিষুষ্ণ বেশ কিছু জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে, যেগুলো উপকূলের লবণাক্ত জমিতে চাষাবাদ করে ভালো ফলন পাওয়া যেতে পারে। এই প্রতিকূলতা-সহিষুষ্ণ স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত উপকূলের লবণাক্ত জমিতে চাষাবাদ করলে পরে ডাল বা গম শুস্ক মৌসুমে সময়মতো চাষাবাদ করে কাঙ্ক্ষিত ফলন ঘরে তোলা যাবে। রিলে পদ্ধতিতে মটরশুঁটি চাষাবাদের জন্য বীজ, সার ছাড়া আর কোনো খরচ নেই বিধায় পতিত জমিতে কৃষক একটি অতিরিক্ত ফসল ফলাতে পারেন।
ড. এম জি নিয়োগী :ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী
mgneogi@gmail.com
মন্তব্য করুন