
গত বছরের নভেম্বরে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে 'মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি' শীর্ষক প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। মিয়ানমারসহ অল্প কয়েকটি দেশ ছাড়া বিশ্বের সব দেশের অবস্থান রোহিঙ্গা ইস্যুর শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন, রাখাইনে তাদের ফেরার পরিবেশ, কেড়ে নেওয়া অধিকার, গণহত্যার বিচার ইত্যাদি প্রশ্নের কি আদৌ কোনো সমাধান হবে? মিয়ানমারের রাষ্ট্রক্ষমতায় বর্তমানে সেই সামরিক বাহিনী, যারা ২০১৭-এর গণহত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ও অংশগ্রহণকারী।
২০১৭ সালের নির্যাতনে বাধ্য হয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সীমান্তবর্তী নাফ নদ অতিক্রম করে কপবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন উপকূলে এসে ভেড়ে। পরে তারা স্থানীয় বাংলাদেশি, নিরাপত্তা বাহিনী ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহানুভূতি ও সহযোগিতায় নবনির্মিত ক্যাম্পগুলোয় আশ্রয় নেয়। আগে এরূপ নির্যাতন থেকে পালিয়ে আসা আরও চার লক্ষাধিক রোহিঙ্গার সঙ্গে নতুন প্রবাহের সাত লক্ষাধিক যুক্ত হয়ে বর্তমানে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু উখিয়া-টেকনাফের পাহাড়ি এলাকায় নির্মিত ৩৪টি ক্যাম্পে দিনাতিপাত করছে। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে কপবাজারসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। রাখাইন ও কপবাজারে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার পর জাতিসংঘ ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের নিপীড়ন 'জাতিগত নির্মূলের পাঠ্যপুস্তক' উদাহরণ বলে অভিহিত করেছে। অন্যান্য সংস্থা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও রাখাইন বৌদ্ধদের নিপীড়নকে 'মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ', 'গণহত্যা আক্রমণ' বা 'ধীরগতির গণহত্যা' হিসেবে ঘোষণা করেছে।
২০১৭ সালের আগস্টের গণহত্যামূলক নির্যাতনের (পার্সিকিউশন) পর বেশ কয়েকবার জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের প্রশ্নের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। প্রতিবারই রাশিয়া, চীন, ভারতসহ কয়েকটি দেশ মিয়ানমার সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। চার বছর পর গত ১৭ নভেম্বরের সভায় সর্বপ্রথম সর্বসম্মতভাবে ১০২টি দেশ এ প্রস্তাব সমর্থন করেছে, যা এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
স্বাধীনতা-উত্তর বার্মায় আধুনিক বার্মার প্রতিষ্ঠাতা অং সানের (অং সান সু চির পিতা) ওপর আস্থা রেখেছিল রোহিঙ্গারা। কিন্তু তিনি ১৯৪৭-এর জুলাই মাসে আততায়ীর হাতে খুন হন। তার পর থেকে রোহিঙ্গাদের কেবল আশাহতই হতে হয়েছে। এর মধ্যে তাদের সবই গেল নানা কারণে। ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করে তারা আশায় বুক বেঁধেছিল, তাদের বুঝি পরিচিতি ও পৃথক ভূখণ্ড দেওয়া হবে। কিন্তু পরিহাসের বিষয়, ব্রিটিশ প্রণীত ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকার মধ্যে রোহিঙ্গারা ঠাঁই পেল না। এ তালিকার ওপর ভিত্তি করেই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের 'অভিবাসী' বা 'বাংলাদেশি' বলে অভিহিত করে এবং চূড়ান্তভাবে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে 'রাষ্ট্রহীন' জনগোষ্ঠীতে পরিণত করে।
২০১৭-এর গণহত্যার ঠিক আগে রোহিঙ্গারা আরেকবার বুকে আশা সঞ্চার করেছিল, যখন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি ২০১৬ সালে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর হয়েছিলেন। রোহিঙ্গারা ভেবেছিল, সামরিক শাসন আমলে তাদের বিরুদ্ধে যে অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হয়েছিল, সু চির নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলে এর অবসান ঘটবে। কিন্তু না, তা হলো না। তারা পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম জঘন্যতম গণহত্যার শিকার হলো সু চির আমলে, ২০১৭ সালের আগস্টে। সু চি কেবল রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার কথা অস্বীকারই করেননি, আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্কেও তিনি অংশগ্রহণ করেছেন 'রোহিঙ্গা' শব্দটি উচ্চারণ না করেই।
২০১৭ সালের পর বাংলাদেশে বসবাসকালে দুবার আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে দু'দিন তাদের ফিরে যাওয়ার তারিখও নির্ধারণ করা হয়েছিল। প্রয়োজনীয় পরিবেশ বা অধিকারের বিষয়াদি সমাধান না করে তাদের জন্য রাখাইন থেকে বাসও পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু একজন রোহিঙ্গাও ফিরে যায়নি। এরপর রোহিঙ্গারা নিজেরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের সম্মানের সঙ্গে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে। মহিবুল্লাহ মাস্টারের নেতৃত্বে প্রত্যাবাসনের পক্ষে রোহিঙ্গাদের মধ্যে জনমত সৃষ্টিসহ আন্তর্জাতিক মহলে যোগাযোগ ও সাক্ষাতের মাধ্যমে তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তারা নিজেরা সচেষ্ট হয়। তাদের গণহত্যার দ্বিতীয় বর্ষ পালনের জন্য ২৫ আগস্ট ২০১৯ তারা বড় ধরনের সম্মেলন করে। ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মহিবুল্লাহ ক্যাম্পের মধ্যেই আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। তার পর থেকে রোহিঙ্গারা যেন স্বপ্ন দেখতে আরও ভয় পায়।
২০১৯ সালে দ্বিতীয় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হওয়ার পর এবং ক্যাম্প ও স্থানীয় সমাজের ওপর ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার চাপ কিছুটা প্রশমনের লক্ষ্যে সরকার এক লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর সমুদ্র উপকূলবেষ্টিত নতুন বিকশিত ভাসানচরে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করে। কিন্তু প্রথমে আত্মীয়-পরিজন ও পরিচিত মুখ ছেড়ে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরের ভাসানচরে অনেকে স্থানান্তর হতে সম্মত ছিল না। তাদের কাছে উখিয়া-টেকনাফে থাকা মানে তাদের বাড়ির সন্নিকটে থাকা। ক্যাম্প থেকে তারা যখন নাফ নদ কিংবা রাখাইনের পাহাড় দেখতে পায়, তারা তাদের বাড়ির গন্ধ পায়; সন্তানদের তাদের পৈতৃক ঠিকানা দেখাতে পারে।
আশা থেকে যতই হতাশার জন্ম হোক, এখনও তারা ফিরে যেতে চায় আপন ঠিকানায়। কিন্তু কবে ঘটবে তাদের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, তা অজানা। হয়তো তাদের অনেকেই থেকে যাবে আজীবন রাষ্ট্রহীন, নামহীন এই ধরণিতে! তারা কি কভু জন্মেছিল কোনো ভূমিতে, ঠাঁই কি হবে তাদের পিতৃভূমিতে? এসব প্রশ্নের উত্তর কেবল ভবিষ্যতেই মিলবে।
মন্তব্য করুন