
অধিকার মানুষের জন্মগত। সমাজের প্রতিটি মানুষ অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিবেচনায় সব মানুষের অবস্থান সব রাষ্ট্রে সমান নয়। চলমান উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় অনেক নাগরিকের অবস্থান অতি নিল্ফেম্ন। সামাজিকভাবে বাদ পড়ছে দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী যারা ধর্ম, জাতিসত্তা, পেশা, শারীরিক অক্ষমতা ও ভৌগোলিক কারণে সামাজিক বৈষম্যের শিকার। নাগরিক হিসেবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জনসংখ্যা পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন সম্পর্কিত সরকারি সেবাপ্রাপ্তিতে তারাও সমান দাবিদার। সমাজে এমন অনেকে আছেন, যারা মানুষ হিসেবে অধিকারবঞ্চিত। তারাই দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত। সমাজ উন্নয়নের ধারায় যুক্ত করতে হবে দেশের সব বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে।
প্রান্তিকতা কী কিংবা সমাজে কারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে গণ্য? প্রান্তিকতা হচ্ছে মানুষের এক ধরনের অবস্থা। এমন অবস্থায় মানুষ অহরহ অবহেলা, বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার। তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ক্ষুধা-দারিদ্র্য, ভগ্নস্বাস্থ্য ও নিরক্ষরতার মধ্যে তাদের জীবন চলা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় যারা নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খায়। অন্যভাবে বলা যায়, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ বলতে বোঝায়, আর্থসামাজিক উন্নয়নের কোনো সূচক যারা অর্জন করতে পারে না, তারাই দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশে দলিত পেশার মানুষদের শ্রেণিবদ্ধ করা হয় তাদের কাজ, ধর্ম ও জাতিসত্তার ভিত্তিতে। দেশে ৩০টিরও বেশি দলিত গোষ্ঠী রয়েছে। যারা দেশের মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন থেকে ৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন লোকের প্রতিনিধিত্ব করে। এই গোষ্ঠীর মানুষ সমাজে অস্পৃশ্য হিসেবে বিবেচিত। ঐতিহাসিকভাবে তারা নির্দিষ্ট কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে তারা সামাজিক বৈরিতার শিকার। সমাজের মূলধারায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের সম্পূর্ণ পৃথক রাখা হয়েছে। সমাজের জন্য তারা অপরিহার্য এবং সমাজে তাদের উপযোগিতা আছে। তাই রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন পরিক্রমায় তাদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। প্রান্তিক গোষ্ঠী কেবল অর্থনৈতিক বৈষম্য নয়; অ-অর্থনৈতিক বৈষম্যেরও শিকার। যেমন- অস্পৃশ্যতা ও ঘৃণা, সামাজিক বহির্ভূতি, মর্যাদার অভাব, জীবিকাহীনতা, জমি থেকে বলপূর্বক উচ্ছেদ, অজ্ঞতা ও তথ্যের অভাব, আইনি সহায়তাপ্রাপ্তির অভাব, পরিবেশগত বিপর্যয় ইত্যাদি। বর্তমান সরকার সমাজকল্যাণবান্ধব সরকার। সরকারের বিভিন্ন দপ্তর দেশের সব অনগ্রসর মানুষের উন্নয়নে বিবিধ কল্যাণমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। সমাজের তৃতীয় লিঙ্গ, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে এ মন্ত্রণালয় ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে অনেক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। কর্মসূচি হলো- বিশেষ ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি, অনুদান প্রদান, প্রশিক্ষণ প্রদান, মূলধন তহবিল সরবরাহ ইত্যাদি। এসব কর্মসূচি সমাজের অনগ্রসর শ্রেণির উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
স্বাধীনতার নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দল বর্তমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার বহুমুখী স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। একমাত্র লক্ষ্য দেশের সব নাগরিককে উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সম্পৃক্ত করা। দেশে বর্তমানে চলমান উন্নয়ন পরিকল্পনা হলো- 'রূপকল্প-৪১ :বদলে যাবে বাংলাদেশ'। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে প্রয়োজন পরিকল্পিত পরিকল্পনা। এ জন্য প্রয়োজন সামাজিক গবেষণা। এ গবেষণার একটি পদ্ধতি হচ্ছে সামাজিক জরিপ। এ গবেষণা পদ্ধতির মাধ্যমে সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষের সামাজিক অবস্থা, সংখ্যা, সম্পর্ক, ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, সম্পদ ও চাহিদা বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়। এ লক্ষ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক 'বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন' শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করা করছে। এ প্রকল্পে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আওতাভুক্ত ১০টি পেশার মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে প্রাপ্ত জরিপের তথ্য বিশ্নেষণক্রমে প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নকল্পে উপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ করবে সরকার। শোষণমুক্ত, ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা এবং মানবাধিকার, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যবোধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার।
মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ : সহকারী পরিচালক, সমাজসেবা অধিদপ্তর, বিভাগীয় কার্যালয়, চট্টগ্রাম
newaz.usso@gmail.com
মন্তব্য করুন