মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে শ্রেণিকক্ষে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ওই বিদ্যালয়ে অফিস সহকারী মো. আসাদের দায়ের করা মামলায় হৃদয় মণ্ডলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায়। আদালত তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান। গত রোববার অবশ্য জেলা ও দায়রা জজ আদালত তাকে জামিন দিয়েছেন। হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল যে ছককষা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার শিকার- এ পর্যন্ত বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উঠে আসা তথ্যে তা অনেকটাই পরিস্কার। আমরা ১৮ জন নাগরিক হৃদয় মণ্ডলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করে বিবৃতি দিয়েছি; যা ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত-প্রচারিত হয়েছে। আমরা ওই বিবৃতিতে এও বলেছি, যে কিশোর শিক্ষার্থীরা মৌলবাদী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে অপমান করেছে; তাদের মানবিক চেতনার বিকাশ ঘটানোর জন্য সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর গভীর করা উচিত। হৃদয় মণ্ডলের ঘটনা নিয়ে যখন তোলপাড় চলছে, তখনই নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার দাউল বারবাগপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা আমোদিনী পাল আরেকটি ঘটনার শিকার।

নিশ্চয় অনেকের মনে আছে নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের কথা। ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল ভক্তকে প্রকাশ্যে অপমান-লাঞ্ছনার শিকার হতে হয় স্থানীয় সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে। শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনেছিল তারই কতিপয় শিক্ষার্থী। তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল ঘুষের অভিযোগও। তাকেও কারাগারে যেতে হয়েছিল; ঘটনাটি দেশব্যাপী বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল; আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও তা উঠে এসেছিল। যে বলবানরা শ্যামল কান্তিকে কান ধরে ওঠবস করে চরম অপমান করেছিলেন, তাদের সেই জঘন্য কাণ্ডের প্রতিবাদে দেশের অনেক মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন। সেই প্রতিবাদী কেউ কেউ প্রকাশ্যে রাস্তায় কান ধরে ওঠবস করে ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ও মূল হোতাদের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানিয়েছিলেন। সম্প্রতি ঢাকার রাস্তায় কলেজ শিক্ষক লতা সমদ্দার টিপ পরার কারণে লাঞ্ছিত হয়েছেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার এক সদস্যের দ্বারা; যে সংস্থার সদস্যদের গুরুদায় জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ভুলে যাওয়ার কথা নয় অধ্যাপক রুমা সরকারের কথাও, যার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছিল।

উল্লিখিত প্রতিটি ঘটনার পর সংবাদমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুভবোধসম্পন্নরা ধিক্কার জানিয়েছেন। শ্যামল কান্তি শেষ পর্যন্ত মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। পরিতাপের বিষয়, রক্তস্নাত বাংলাদেশে যে দেশটির অভ্যুদয়ের পেছনে পুরো জাতির সুনির্দিষ্ট কিছু প্রত্যয় ছিল। কিন্তু ওই প্রত্যয়-চেতনা-মূল্যবোধের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে বর্তমান প্রজন্মের প্রতিনিধিদের একাংশকে। শিক্ষার্থীকে দিয়ে শিক্ষককে ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় জড়িয়ে লাঞ্ছিত-অপমানিত করা হচ্ছে। কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। আমাদের শিক্ষার্থীদের পরিকল্পনা করে সাম্প্রদায়িক বিষে বিষাক্ত করার চক্রান্তের ক্রমেই বিস্তার ঘটছে। দেশের আগামী প্রজন্ম কী ভয়ংকর জীবাণু ধারণ করে বেড়ে উঠছে, তা ভাবলে গা শিউরে ওঠে।

পরিবার সবচেয়ে বড় শিক্ষালয়। ওই শিক্ষালয়ে শ্যামল কান্তি ও হৃদয় মণ্ডলের শিক্ষার্থীরা কী শিক্ষা পাচ্ছে? তারা দেশ-জাতির জন্য কোন বার্তা নিয়ে বড় হচ্ছে? বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তো বটেই, এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও শিক্ষকদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মর্যাদাসহ নানা রকম সুযোগ-সুবিধা বিস্তৃত। আর আমাদের সমাজে শ্রেণিকক্ষেও একজন শিক্ষকের পাঠদানের পথ বিপৎসংকুল হয়ে উঠেছে। বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করে যূথবদ্ধভাবে দাঁড়াতে যদি আমরা এখনও সময়ক্ষেপণ করি তাহলে চক্রান্তকারী, প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী, সমাজবিরোধীরা আরও আশকারা পাবে। ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটাতে তারা পিছপা হবে না।

একটি সভ্য-মানবিক সমাজের চিত্র তো এমন হতে পারে না। আমরা এ পর্যন্ত বহুবার বলেছি, এদের কোনো ছাড় দেওয়া উচিত হবে না। এদের মনোজগৎ অন্ধকার, চিন্তার দৈন্য প্রকট। এরা রামু, নাসিরনগর, সুনামগঞ্জ, পাবনায় অপকৌশলে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে সমাজদেহ ক্ষতবিক্ষত করেছে। এরা স্বাধীনতার শত্রু, মানবতার শত্রু, দেশ-জাতি এমন কি ধর্মেরও শত্রু। কোনো ধার্মিক মানুষ এমন গর্হিত কাজ কখনোই করতে পারেন না। আমাদের মনে আছে, প্রতিক্রিয়াশীলদের 'আবদার' মেনে নিয়ে পাঠ্যবইয়ে সাম্প্রদায়িকতার স্পর্শ লাগানো হয়েছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণ থেকে সরে আসা হয়েছিল। এমন আরও অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের ক্ষেত্র ক্রমেই বড় করে দেওয়া হয়। প্রশ্ন হচ্ছে- দেশ-জাতি কি এরই মাশুল গুনছে? প্রগতির পথে কি এভাবেই প্রক্রিয়াশীলতার ছায়া বিস্তারের পথ করে দেওয়া হয়েছে?

আমাদের সমাজে ভিকটিম যতটা সামাজিক ও আইনি সহায়তা-সহযোগিতা পান; কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুস্কর্মকারীরা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের অসাধু ও নীতিহীন রাজনীতিকদের কল্যাণে তার চেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়ে অপরাধের অভিযোগ থেকে নিস্কৃতি পেয়ে যায়- এমন খেদোক্তি অমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ কতটা? মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডসহ যে কোনো নেতিবাচকতার ছায়া প্রলম্বিত হবে- তা তো প্রত্যাশিত ছিল না। আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাহাত্তরের সেই সংবিধানের সবকিছু এখনও ফিরে পাইনি, যে সংবিধানে দেশের আইন ও রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা বঙ্গবন্ধুর লালিত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। পঁচাত্তরের মর্মন্তুদ অধ্যায়ের হোতারা ও তাদের প্রশ্রয় দানকারী, লালনকারী, পশ্চাৎপদ চেতনাধারীরা নিজেদের হীনস্বার্থে দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে তাদের মতো করে সংবিধানে সংযোজন-বিয়োজন ঘটিয়েছেন, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত। কিন্তু এখন তো সেই অন্ধকার নেই। তারপরও কেন আমরা ফিরে যেতে পারছি না বাহাত্তরের সংবিধানে হূত সবকিছু পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে? এই না-পারাই কি হৃদয় মণ্ডলদের তালিকা দীর্ঘ করছে? ক্ষতের ওপর ক্ষত সৃষ্টি করছে?
ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার- বহুল উচ্চারিত এই বাক্যের কতটা বাস্তব প্রতিফলন সমাজে দৃশ্যমান? আমরা দেখছি, যেন প্রায় সর্বক্ষেত্রে ধর্মকে মুখোমুখি নিয়ে আসার একটা হীন চেষ্টা থাকে। হৃদয় মণ্ডলের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমরা স্বাধীনতার ৫১ বছরেও কেন একাত্তরের প্রত্যয়ের বাংলাদেশ গড়তে পারলাম না? যারা হৃদয় মণ্ডলের জন্য ফাঁদ পেতেছিল, তাদের বিরুদ্ধে কেন এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয় না, যে ব্যবস্থা এমন মানসিকতাধারীদের সামনে সতর্কবার্তা হয়ে থাকবে? একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন হয়নি। উপরন্তু শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণ এক বিপদাশঙ্কার সৃষ্টি করেছে। সেই শঙ্কা দূর করার প্রয়াস মুখ্যত সরকারের দিক থেকে বিলম্বে হলেও এখনই আমরা দেখতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি, দেশের বৃহদাংশের এমন পদক্ষেপে অকুণ্ঠ সমর্থন থাকবে।

দেশের মানুষ ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো বিরোধ ছাড়াই লেখাপড়া করেছে; করছে। হৃদয় মণ্ডলের মর্মস্পর্শী ঘটনা ফের অনেক বার্তা দিয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ করেছে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকেও। সাম্প্রদায়িক, প্রতিক্রিয়াশীল চক্রগুলোর অপতৎপরতা বন্ধে সরকারের নির্মোহ ও অনমনীয় অবস্থানের বিকল্প নেই। এই ভূখণ্ডে হাজার বছর ধরে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রয়েছে। তা ছিন্ন করতে যারা তৎপর তাদের ব্যাপারে কোনো অনুকম্পা আমরা দেখতে চাই না। কঠোর অবস্থান নিয়ে তাদের দমন করতেই হবে। এ পর্যন্ত এমন যত ঘটনা ঘটেছে, এর কঠোর প্রতিকার নিশ্চিত করতে হবে দ্রুত। হৃদয় মণ্ডল ও তার স্বজনদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার মধ্য দিয়ে এই জনগুরুত্বপূর্ণ কাজটি শুরু হোক এখনই।

সেলিনা হোসেন :কথাসাহিত্যিক