
জাতীয় বাজেট দেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দলিল। দেশ পরিচালনার জন্য করারোপ ও বাজেট বরাদ্দ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জীবনমানকে বিভিন্ন মাত্রায় প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের ৩০ লক্ষাধিক পিছিয়ে পড়া আদিবাসীর জীবনমান উন্নয়নের জন্যও বাজেট সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিগত বছরের বাজেটগুলোয় ছিল না আদিবাসীদের জন্য কোনো সুস্পষ্ট অর্থ বরাদ্দ। বিভিন্ন জায়গায় প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ থাকলেও তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। জাতীয় বাজেটে আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্তিকরণের জন্য প্রয়োজন আদিবাসীবান্ধব বাজেট।
করোনাকালে আদিবাসীদের মাত্রাতিরিক্ত প্রান্তিকতা বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করেছে। কভিডকালে পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের কৃষি আয় ঠেকেছে তলানিতে। বেশিরভাগ বেসরকারি চাকরিজীবী হয়েছেন চাকরিচ্যুত। ঢাকা শহরে আদিবাসী মেয়েদের পরিচালিত অনেক বিউটি পার্লার বন্ধ হয়েছে। সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে বেড়েছে উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা। আদিবাসীরা স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার হয়েছে- এ ধরনের উদাহরণ অসংখ্য। বেশিরভাগ আদিবাসী সরকার ঘোষিত কভিড প্রণোদনা প্যাকেজ হাতে পায়নি। আদিবাসী কোমলমতি শিশুরা উপকরণের জন্য অনলাইন শিক্ষায় যোগ দিতে পারেনি। কভিড মহামারি নিয়ন্ত্রণে আদিবাসী অঞ্চলে আদিবাসী ভাষায় ক্যাম্পেইনে সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। উপরন্তু এ সময়ে আদিবাসীদের জমি জবরদখল এবং আদিবাসী নারী-শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে কয়েক গুণ, যা আদিবাসীদের উন্নয়নকে ব্যাহত করেছে।
আগামী বাজেট ২০২২-২৩ অর্থবছরে আদিবাসীদের অধিকার সুনিশ্চিতকরণে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাবনা এ জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়নে সহায়ক হবে, আশা রাখি। আগামী বাজেটে আদিবাসীদের অধিকার সুনিশ্চিতকরণের প্রস্তাবনা নিম্নরূপ :
জাতীয় বাজেটে আদিবাসী বাজেট পৃথক অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করা। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঠিক মানচিত্রায়ণ ও সংখ্যা নিরূপণ করে তাদের সংখ্যানুপাতে বাজেট বরাদ্দ করতে হবে।
আদিবাসীদের জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। সব মন্ত্রণালয় বা বিভাগের বাজেটে আদিবাসীদের জন্য সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখতে হবে। বণ্টনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে আদিবাসীদের সম্পৃক্তকরণের নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন জেলা পরিষদে বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে।
সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন এবং বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। যতদিন পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন না হবে ততদিন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে পার্বত্য মন্ত্রণালয় যে কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমতলের আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ দিতে হবে।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ও সামাজিক ক্ষমতায়নের বাজেট খাতে আদিবাসী উপকারভোগী যাতে নিশ্চিত হয়, তার জন্য এ বিষয়ে নির্দেশনা থাকতে হবে। উচ্চশিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষায় বৃত্তিসহ আদিবাসী নারী ও তরুণদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে।
আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, নিজ নিজ মাতৃভাষার শিক্ষক নিয়োগ এবং পর্যায়ক্রমে দেশের সব আদিবাসী ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয় বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হবে।
আদিবাসীদের নিজ নিজ সামাজিক অনুশাসন, প্রথা, কৃষ্টি, নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস ও মর্যাদা বৃদ্ধি এবং প্রতিপালনে 'আদিবাসী কল্যাণ ট্রাস্ট' গঠন করতে হবে। আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক একাডেমিগুলোতে আদিবাসীদের সংস্কৃতি উন্নয়নে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে এবং তাদের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও গবেষণার জন্য বিশেষ বরাদ্দসহ একাডেমির পরিচালক, কর্মকর্তা বা কর্মী নিয়োগে আদিবাসীদের প্রাধান্য দিতে হবে।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও আদমশুমারি ২০২১-কার্যক্রমের সঙ্গে আদিবাসীদের সরাসরি সম্পৃক্ত রাখতে হবে। সব আদিবাসী জাতিসত্তার আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিচয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিভাজিত তথ্য সংগ্রহে উদ্যোগ নিতে হবে এবং সব উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ বাজেট রাখতে হবে।
খোকন সুইটেন মুরমু: আদিবাসী অধিকারকর্মী ও প্রকল্প সমন্বয়কারী, কাপেং ফাউন্ডেশন
ksmurmu@gmail.com
মন্তব্য করুন