
আমরা যে পরিস্থিতির মাঝে আছি তাতে মনে হচ্ছে, চারদিকে ডায়রিয়ার দাপট; কলেরা জীবাণুর রক্তচক্ষু আস্ম্ফালন। করোনায় মৃত্যু থেমে গেছে। অতিক্রম করছি করোনায় মৃত্যুবিহীন দিন। এটি স্বস্তিদায়ক সংবাদ। কিন্তু এর মাঝে উদ্বেগের খবর হলো, ডায়রিয়ায় মৃত্যু হচ্ছে। এমনকি এক দিনে ২৫ জনের মৃত্যুর ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশ পেয়েছে। ডায়রিয়া নিরীহ রোগ মনে হলেও এটি এক সময় মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। বিভিন্ন ধরনের আণুবীক্ষণিক জীবাণু দ্বারা ডায়রিয়া হয়ে থাকে। এর মাঝে একটি মারাত্মক জীবাণু হলো কলেরার জীবাণু। তীব্র ডায়রিয়াকে আমরা অনেক সময় কলেরা বলে থাকি। যদিও কলেরা একটি ভিন্ন রোগ। ভিব্রিয়ো কলেরি নামক এক ধরনের জীবাণুর আক্রমণে হয় কলেরা। আইসিডিডিআর,বি তাদের গবেষণায় কলেরা জীবাণু চিহ্নিত করেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। সুতরাং বলা যায়, কলেরার জীবাণু এখনও রয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে। অবহেলা করলে এটা হতে পারে প্রাণসংহারক। পৃথিবীব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে এটি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি ছয় সেকেন্ডে বিশ্বে একটি শিশু মারা যাচ্ছে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে। বয়োবৃদ্ধ এবং যারা অন্যান্য ক্রনিক রোগে আক্রান্ত, তাদের ক্ষেত্রে ডায়রিয়া হতে পারে ভয়ানক বিপজ্জনক। সুতরাং ডায়রিয়া কিংবা কলেরা থেকে সাবধান।
ডায়রিয়ার কারণে পানিশূন্যতা সৃষ্টি হয়। তীব্র ডায়রিয়ার আক্রমণে অনেক সময় কয়েক ঘণ্টার মাঝে ১০ থেকে ২০ লিটার পানিশূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে। তীব্র পানিশূন্যতার কারণে রক্তচাপ কমে যায়; হূৎস্পন্দন বৃদ্ধি পায়; মূত্র উৎপাদন কমে যায়। শরীর নেতিয়ে পড়ে। কিডনির মাঝে রক্ত সঞ্চালন কমে যাওয়ার কারণে এক সময় কিডনি বিকল হয়ে পড়ে। রক্তে আয়নের ঘাটতি দেখা দেয়। বিশেষত সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্লোরাইড এবং ম্যাগনেসিয়াম আয়নের ঘাটতির কারণে হূৎস্পন্দন এলোমেলো হয়ে পড়ে। কিডনি বিকল হয়ে যাওয়ার কারণে রক্তে অম্ল ও ক্ষারের ভারসাম্যতা নষ্ট হয়ে যায়। রক্তে অম্লের আধিক্য সৃষ্টি হয়। সময়মতো এবং দ্রুত চিকিৎসা নিলে ডায়রিয়ার কারণে সৃষ্ট কিডনি ফেইলিউর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভালো হয়ে যায়। এটি আশাব্যঞ্জক। কিন্তু ১০ থেকে ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে কিডনি আজীবনের জন্য বিকল হয়ে যেতে পারে। যাদের আগে থেকে কিডনির রোগ রয়েছে তাদের ডায়রিয়ার আক্রমণ কিডনির ব্যাধির তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। ডায়রিয়ার তীব্রতায় এমন হয়, মাঝেমধ্যে রোগীর পায়ুপথের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলে রোগী কল কল করে পায়খানা করে কাপড়-চোপড় নষ্ট করে দেয়।
কলেরাকে বলা হয় দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যের সঙ্গী। আমাদের দুর্ভিক্ষ নেই, দারিদ্র্য অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু কলেরা জীবাণু এখনও আছে এবং কলেরা কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ। কলেরায় আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। খোদ রাজধানী এবং এর আশপাশে কলেরা জীবাণুর বিস্তার ঘটছে। কলেরায় পায়খানা হয় অনেকটা চাল-ধোয়া পানির মতো পাতলা। সঙ্গে হয় বমি। পাতলা পায়খানা এবং বমি অল্প সময়ের মাঝে পানিশূন্যতা সৃষ্টি করে রোগীকে নিয়ে যেতে পারে বিপর্যয়ের দিকে। ৮০ শতাংশ মানুষ কলেরার জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পরও তেমন লক্ষণ তাদের মাঝে প্রকাশ পায় না। বলা যায়, এদের ইনফেকশন এমনিতেই সেরে যায়। কিন্তু ২০ শতাংশের ক্ষেত্রে মারাত্মক ধরনের ডায়রিয়া, বমি এবং হাত-পা কুঁকড়ে আসার লক্ষণ প্রকাশ পায়। যে কোনো জীবাণু পেটে প্রবেশ করলে সেখানকার অম্লীয় পরিবেশে জীবাণু সাধারণত টিকে থাকতে পারে না। আমরা অনেকেই মুড়ি-মুড়কির মতো অম্লনাশক বিভিন্ন ধরনের ওষুধ খেয়ে থাকি। এ ধরনের ওষুধ হলো প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর অথবা অ্যান্টাসিড গ্রুপের ওষুধ। যারা নিয়মিত এ ধরনের ওষুধ সেবন করেন তারা সহজেই জীবাণুর সহজ আক্রমণের শিকার হন। কেননা, তাদের পেটের অম্ল প্রশমিত অবস্থায় থাকে।
ইতিহাস বলে, কলেরার আদি স্থান গঙ্গা অববাহিকায়। পৃথিবীতে সাতবার কলেরা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রায় সব মহামারিরই উৎপত্তি ভারতীয় উপমহাদেশে। প্রথম মহামারি হয়েছিল ১৮১৭ সালে। প্রথম তিনটি মহামারিতে তৎকালীন ভারতের দেড় কোটির বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। পরের তিনটি মহামারিতে মারা যায় ভূ-ভারতের দুই কোটি ৩০ লাখ মানুষ। ভারত থেকে কলেরা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। এক সময় কলেরার ভয়ানক সংক্রমণে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। সে সময় মানুষকে না খাইয়ে রাখা হতো। এমনকি পানি পর্যন্ত দেওয়া হতো না। পানিশূন্যতার কারণে নেমে আসত মৃত্যু। এখন চিকিৎসাবিজ্ঞান অনেক উন্নত হয়েছে, তবু মৃত্যু থেমে নেই। কারণ আমাদের অসচেতনতা। আমরাই পানিশূন্যতার সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছি।
বলা হয়ে থাকে, কলেরা পছন্দ করে নোংরা, ঘিঞ্জি পরিবেশ ও দূষণ। যেখানে নোংরা, যেখানে দূষণ, যেখানে কদর্য সেখানেই কলেরার দাপট। সুপেয় পানি, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, পরিস্কার আঙিনা কলেরা প্রতিরোধে সহায়ক। ১৮৫৪ সালের সেপ্টেম্বরে লন্ডনে এক শিশু কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। তার মা পায়খানাদুষ্ট কাপড়গুলো ধৌত করে একটি ড্রেনের পাশে। ড্রেনের পানির সঙ্গে মিশে যায় কলেরার জীবাণু। অনতিদূরেই ছিল পানির পাম্প। ঘটনাক্রমে ড্রেনের ইট এবং পানির পাম্পের ইট সে সময় বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিল। ফলে ড্রেনের পানি মিশে যায় পাম্পের পানির সঙ্গে। বিষয়টি কেউ লক্ষ্য করেনি। সেই পাম্পের পানি পান করল অনেক মানুষ। তারা সবাই আক্রান্ত হলো কলেরায়। কয়েক দিনের মাঝে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল ৫০০ মানুষ। লন্ডনের বিখ্যাত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. জন স্নো আবিস্কার করলেন বিষয়টি। তার নির্দেশনায় সরিয়ে ফেলা হলো পানির পাম্প। আরও অসংখ্য মৃত্যুর হাত থেকে তখন বেঁচে গেল লন্ডনের মানুষ। কলেরা আর ডায়রিয়া ছড়াচ্ছে পানি এবং খাবারের মাধ্যমে। আমরা কি নিরাপদ পানি পান করছি? আমরা কি দূষণমুক্ত খাবার খাচ্ছি? ডায়রিয়া-কলেরার এত বিস্তার কেন? নিঃসন্দেহে আমাদের ভেতরে কাজ করছে দূষণ। পানির সঙ্গে, খাবারের সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়ত গলাধঃকরণ করছি জীবাণু; হয়তো কলেরা, নয়তো আমাশয়ের। মনে রাখা দরকার, একবার ডায়রিয়া হলে পরিবেশে ১০ লাখ গুণ ডায়রিয়া সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। যেভাবে চারদিকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ; তাতে আমাদের নগর, বন্দর, জনপদ ডায়রিয়ার জীবাণুতে ভরে যাচ্ছে।
লে. কর্নেল নাসির উদ্দিন আহমদ: চিকিৎসক
মন্তব্য করুন