
সুনামগঞ্জ জেলার ১৪টি হাওরের ছয় হাজার হেক্টর বোরো ফসল গত কয়েক দিনের পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে। অন্যগুলো রয়েছে ঝুঁকিতে। ১৭ এপ্রিল সমকালে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, অনেক বাঁধে এরই মধ্যে নতুন করে ফাটল দেখা দিয়েছে। ২০১৭ সালে বাঁধ সংস্কারে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে সুনামগঞ্জের সব এবং নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলার অনেক হাওর তলিয়ে যায়। লাখো কৃষকের সারাবছরের জীবিকার উৎস বিনষ্ট হয়। ব্যাপক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। দুই কোটি হাওরবাসী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফসল হারানোয় সুনামগঞ্জের আপামর জনতা বিভিন্ন দাবি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে ফুঁসে ওঠে। ফলে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সুনামগঞ্জ সফর করেন এবং আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন।
হাওরাঞ্চলের অবস্থান ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়শ্রেণির পাদদেশে, যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। পাহাড়ে বৃষ্টি হলে ঢল নেমে ছড়া-খাল-নদী দিয়ে ভাটিতে চলে যায়। এটাই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম। অতীতে পাহাড়ে ঘন জঙ্গল থাকায় বৃষ্টির পানি ধীরে ধীরে কয়েক দিনে নেমে আসত। বর্তমানে পাহাড়গুলো ন্যাড়া হওয়ায় বৃষ্টিপাতের দু-তিন ঘণ্টার মধ্যেই ঢল আসে। সর্বোপরি হাওরাঞ্চলের নদীগুলো ভরাট হয়ে পানি ধারণ ও বহনের সক্ষমতা হারিয়েছে। আগাম বন্যা তিন-চার বছর একটানা নাও হতে পারে। আবার পরপর একাধিক বছরও হতে পারে। ফসলহানি হলেই কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মুখস্থ কথা- উজানে ভারতের মেঘালয়ে অত্যধিক বৃষ্টিপাতের কারণে হাওরে পানি ঢুকেছে। এসব কথা বিভ্রান্তিকর।
ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ করাই হয় পাহাড়ি ঢল ঠেকানোর জন্য। বারবার হাওরে বিপর্যয়ের কারণ মূলত ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি। ফসল রক্ষা বাঁধের কার্যক্রম ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাউবোর একক নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। বাঁধের কাজ করা হতো প্রধানত ঠিকাদারদের মাধ্যমে। জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে ঠিকাদারি ব্যবস্থা রহিত করে হাওর এলাকায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত, নদী বা খাল পুনঃখননের জন্য স্কিম প্রস্তুত ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাবিটা নীতিমালা ২০১৭ প্রণয়ন করা হয়। নীতিমালা পরিবর্তন হলে কৃষকরা সঠিকভাবে বাঁধ মেরামত করতে পারবে- এই আশাবাদ তৈরি হয়। এর পরও কেন ফসলহানি হচ্ছে?
২০১৮ সাল থেকে কাবিটা নীতিমালা ২০১৭ অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে বাঁধের কাজ করা হচ্ছে। তখন থেকেই নতুন ব্যবস্থায় দুর্নীতির বিস্তার ঘটে। লুটপাটের উদ্দেশ্যে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক অপ্রয়োজনীয় বাঁধ তৈরি করা হয়। প্রয়োজনীয় বাঁধগুলোতে দুরমুশ করা হয় না। লাগানো হয় না ঘাস। অথচ এসব খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ থাকে। গোড়া থেকে মাটি কেটে করা হয় দুর্বল বাঁধ। থাকে না নিয়ম অনুযায়ী বাঁধের ঢাল। এসব বিষয়ে প্রতি বছরই আন্দোলনকারীরা সক্রিয় ছিলেন। বিগত চার বছর পাহাড়ি ঢল না আসায় বাম্পার ফলনে নীতিমালার দুর্বলতা ও অনিয়ম নিয়ে কেউ ভাবেনি। এবারের ফসলহানির পর ফের বিষয়গুলো সামনে এসেছে।
নীতিমালা অনুযায়ী স্কিম প্রস্তুত, বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কাজের সমন্বয়ের জন্য জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসককে সভাপতি ও পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীকে সদস্য সচিব করে একটি কমিটি রয়েছে। আছে উপজেলা পর্যায়ে কমিটি। পিআইসি গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে ৬(৩) দফায় বলা হয়েছে, পিআইসির ক্ষেত্রে বাঁধের সন্নিকটবর্তী জমির প্রকৃত মালিকদের সমন্বয়েই কেবল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পিআইসি গঠন করবেন। প্রয়োজনে ভূমি অফিস, কৃষি অফিস ও সংশ্নিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পরামর্শ করবেন। পিআইসিগুলোর কাজ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং করে পূর্বোক্ত একই উপজেলা কমিটি। একটি প্রকল্পে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ হয়। কোনো কোনো উপজেলায় শতাধিক প্রকল্পও হয়। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের দায়িত্ব মূলত দু'জন ব্যক্তির ওপর অর্পিত। কমিটি রাবার স্ট্যাম্প মাত্র। তদুপরি পিআইসি গঠন এককভাবে ইউএনওর দায়িত্ব। রয়েছে এমপি-সচিবদের ডিও লেটারের উৎপাত ও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ।
হাওরের ফসল সুরক্ষা করতে জনআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী নীতিমালা সংশোধন করতে হবে। স্কিম প্রস্তাব করবেন একাধিক প্রকৌশলী এবং যে হাওরের জন্য প্রকল্প সেই হাওরের কৃষক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি। বর্তমানে বিদ্যমান উপজেলা কমিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন তদারকি করবে। উভয় কমিটির সদস্য সচিব ভিন্ন কর্মকর্তা হতে হবে। এক কমিটির সদস্য সচিবকে অন্য কমিটির সদস্য রাখা যেতে পারে। মনিটরিং কমিটিতে স্থানীয় কৃষক সংগঠন প্রতিনিধি, এনজিও প্রতিনিধি, গণমাধ্যমকর্মীদের রাখতে হবে। পিআইসি গঠিত হবে গণশুনানির মাধ্যমে; শুধু সংশ্নিষ্ট হাওরে ধান আবাদ করেছেন এমন কৃষকদের নিয়ে। ফসল সুরক্ষার স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের আগ পর্যন্ত বাঁধনির্ভরতা মূলত অস্থায়ী ব্যবস্থা। যত দ্রুত সম্ভব মেঘনা, সুরমা, কুশিয়ারাসহ হাওরাঞ্চলের সব নদী-নালা খনন করতে হবে।
সালেহিন চৌধুরী শুভ: নির্বাহী পরিচালক, হাউস
মন্তব্য করুন