গত ৬ এপ্রিল বুধবার জাতীয় সংসদে জেলা পরিষদ বিল নিয়ে আলোচনার সময় বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ রাজধানীর যানজট নিয়ে সমালোচনা করলে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে বলেন, আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে উন্নয়নের ঠেলায় উপজেলায়ও ট্রাফিক জ্যাম হবে। একজন মন্ত্রীকে যুক্তি দিয়ে কথা বলতে হবে। আপনি হয়তো উন্নয়নের ফিরিস্তি দিতে গিয়ে যুক্তি দিয়ে কথা বলতে না পেরে অতিকথন করে ফেলেছেন। কিন্তু আপনার এমন অতিকথন সরকারের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে।

দেশের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আপনার কথা মোতাবেক সেই উন্নয়ন আমরা চাই না, যে উন্নয়ন উপজেলা পর্যন্ত ট্রাফিক জ্যাম তৈরি করবে। আমরা এমনিতেই দেশের রাজধানী ঢাকায় যানজটে অতিষ্ঠ। মহামারির বিধিনিষেধ পেরিয়ে গত মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত পুরোপুরি চালু হওয়ার পর যানজটে নাভিশ্বাস উঠছে রাজধানীবাসীর। রোজা শুরুর পর যানজট আরও অসহনীয় হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থেকে ইফতারও পথে করতে হচ্ছে অনেককে। এ সমস্যা নিরসনে কী করবেন, সেই আশার বাণী না শুনিয়ে আপনি শুনিয়েছেন অনাকাঙ্ক্ষিত কথা। বছর ঘুরে আসে, কিন্তু যানজট নিরসনে কথার কথা ছাড়া কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।

জানা গেছে, ঢাকায় গত তিন মাসে নিবন্ধিত হয়েছে আট হাজার ব্যক্তিগত গাড়ি, বিপরীতে বাস ও মিনিবাস নিবন্ধন করা হয়েছে মাত্র ৩৬২টি। আর সবচেয়ে বেশি নিবন্ধিত হয়েছে মোটরসাইকেল, যার সংখ্যা ২৯ হাজার ১০৮। নগর ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি শহরের আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকা দরকার হলেও ঢাকায় আছে ৯ শতাংশের মতো। এ অবস্থায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে গণপরিবহন বাড়ানোর পরামর্শ বিভিন্ন সময় দেওয়া হলেও তা আমলে নেওয়া হচ্ছে না। ফলে যানজট নিরসনে ফ্লাইওভার, ওভারপাস, আন্ডারপাস, মেট্রোরেলের মতো নানা প্রকল্প নেওয়া হলেও ব্যক্তিগত ছোট ছোট গাড়ির সংখ্যা বেড়ে চলায় এসব প্রকল্প যানজট নিয়ন্ত্রণে তেমন কাজে আসছে না।

মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি কিনতে ঝুঁকছে কেন? পরিস্থিতি যেন এই, ঋণ করে হলেও একটি ব্যক্তিগত গাড়ি চাই। দুর্নীতিবাজ ছোট ছোট সরকারি কর্মচারীও আরামে চলতে চায়। ঢাকার জীবনযাপন ব্যয় যা, তাতে পঞ্চম গ্রেডের একজন সরকারি কর্মচারীরও একটি গাড়ি মেইনটেইন করতে পারার কথা নয়। অথচ সরকারই ঋণ দিয়ে ওই গ্রেডের কর্মচারীকে গাড়ি কিনতে উৎসাহিত করেছে। মেনে নিলাম, নূ্যনতম পঞ্চম গ্রেড পর্যন্ত না হয় সরকার স্বীকৃত। কিন্তু এর নিচের দিকে, এমনকি অফিস সহায়ক ধরনের পদের কর্মচারীও যদি গাড়িতে চড়তে চায়, তাহলে কী অবস্থা দাঁড়াতে পারে? অনেক পরিবারের স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী পরিবহনে এখন গাড়ি যেন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন এত ব্যক্তিগত গাড়ি চাই- সেটি অনুধাবন করার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। বর্তমানে ঢাকা শহর অচল হয়ে যাওয়ার মতো এ পরিস্থিতি তৈরি হতো না। সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীলরা এ ব্যাপারে যদি সজাগ হতেন; রাজধানীতে চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত আরামদায়ক গণপরিবহন নেই। পরিবার-পরিজন নিরাপদে চলাফেরা করার উপযোগী কোনো উপায় নেই। সন্তানকে নিরাপদে স্কুলে পাঠানোর সহজ উপায় নেই। তাহলে কী করবে মানুষ? খুব স্বাভাবিকভাবেই লক্কড়-ঝক্কড় গণপরিবহনে ভিড় ঠেলে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে চলাচল না করে সামর্থ্য থাকলে ব্যক্তিগত গাড়ি কিনতেই আগ্রহী হবে।

বিস্ময়কর হলো- ব্যক্তিগত গাড়ির প্রতি ঝোঁক বন্ধ করার জন্য সরকারের নূ্যনতম পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। উন্নত বিশ্বে সরকারের বড় কর্মকর্তারাও গণপরিবহনে চড়েন। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক নিম্ন পর্যায়ের মানুষকেও ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা হয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রথমে সরকারের লোকজনকে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার সীমিত করতে হবে। বিনিময়ে তাদের জন্য উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আর গাড়ি যাদের পাওয়ার কথা নয়; তাদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজনে ব্যক্তিগত গাড়ি রেজিস্ট্রেশনে কঠোর নীতি প্রয়োগ করতে হবে। রাজধানীর যানজটের অন্যতম কারণ বলা হয় স্কুলগামী বাচ্চাদের পরিবহনে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার। এ কথা সত্য, একটি ব্যক্তিগত গাড়িতে একজন পরিবহন করা হয়। এতে স্কুল-কলেজের আশপাশে ব্যক্তিগত গাড়ির দীর্ঘ লাইন লেগে যায়। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যক্তিগত গাড়িতে আসার ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করুক। স্কুল ড্রেসের প্রচলন হয়েছিল শিশু-কিশোরদের মধ্যে সমতা বিধানের ধারণা থেকে। সেই সমতার মারাত্মকভাবে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার। স্কুলে এসে কেউ কোটি টাকার ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে নামছে; কেউ কয়েক লাখ টাকার গাড়ি থেকে নামছে। আবার কেউ হেঁটে, সাইকেলে বা রিকশায় স্কুলে আসছে। এতে সমতার পরিবেশে অভিঘাত লাগছে। শিশুকালেই ধনী-গরিবের ব্যবধান রচিত হচ্ছে। সমতা আর সহনশীলতার সমাজ নির্মাণে উৎসাহ জোগাতে হলেও ব্যক্তিগত গাড়ি বন্ধ করুন। ব্যক্তিগত গাড়ি বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান যাতে পরিবহন সেবা নিশ্চিত করতে পারে, এ জন্য সরকারের সহায়তা দরকার। ঢাকাবাসী বিশ্বের সবচেয়ে বসবাসের অযোগ্য শহরের কালিমা আর নিতে চায় না। কারণ, একটি ভালো শহর চেনা যায় তার গণপরিবহন দিয়েও। রেজিস্ট্রেশনের ব্যাপারে কঠোর নীতিমালা প্রয়োগ করুন। ব্যাপকভাবে আরামদায়ক গণপরিবহন নিশ্চিত করুন। রাস্তার পরিমাণ কাঙ্ক্ষিত ২৫ শতাংশ না হলেও ১৫-২০ শতাংশে উন্নীত করার প্রচেষ্টা নিন। এই অসহনীয়তা অনিবার্য নিয়তি হয়ে থাকতে পারে না।

সাজ্জাদ কাদির: বিটিভির উপস্থাপক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা
sazzadkadir71@gmail.com