এটা সত্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মানুষের মতপ্রকাশের অবাধ সুযোগ করে দিচ্ছে। এই মাধ্যম অনেক বেশি অংশগ্রহণমূলক, যেখানে সাধারণ পাঠক বা দর্শক অংশগ্রহণ করতে পারছে, মতামত দিতে পারছে। রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের জন্যও মতপ্রকাশ ও বিনিময়ের অসাধারণ সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তবে এই মাধ্যমগুলোতে, বিশেষ করে ফেসবুক এবং ইউটিউবে যথাযথ গেটকিপিং ব্যবস্থা নেই। এজন্য এই মাধ্যম দুটো ব্যবহার করে অনেক সময় বুলিং, হ্যারাসমেন্টসহ বিভিন্ন অপরাধ করা হচ্ছে। ছড়ানো হচ্ছে ঘৃণাবাক্য, ভুয়া তথ্য ও গুজব। তাই অপব্যবহার প্রতিরোধে এক্ষেত্রে প্ল্যাটফর্মের মালিক হিসেবে ফেসবুক ও ইউটিউবের জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতার বিষয়টি জরুরি।

বস্তুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিতর্ক আছে বিশ্বজুড়েই। ইতোমধ্যে একটি বিষয় স্পষ্ট, প্ল্যাটফর্মের দায়িত্বশীল ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য মাধ্যমগুলোর কর্তৃপক্ষেরও দায় আছে। কারণ এই মাধ্যম ব্যবহার করে বিপুলসংখ্যক মতলববাজ ব্যবহারকারী যেমন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে, তেমনি মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য দিয়ে ব্যক্তি চরিত্র হননসহ সামাজিক সংকটও তৈরি করছে। ফেসবুক নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন দেশে আইন হয়েছে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন' নামে যে আইনি সুরক্ষা প্রণীত হয়েছে, সেটি ইতোমধ্যেই ত্রুটিপূর্ণ প্রমাণিত। এই আইন দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি বরং নিরপরাধ মানুষকে জেল খাটানোর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে; সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের মোক্ষম দাওয়াই হয়ে গেছে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে এটি এমন একটি আইন যার প্রয়োগই অপপ্রয়োগ হয়ে যেতে পারে। অথচ সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে একটি কার্যকর আইন আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল।

ইউরোপ, আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোতে ফেসবুকের ফ্যাক্টচেকিং টুলস এবং হিউম্যান ফ্যাক্টচেকাররা অত্যন্ত সক্রিয়। কারণ ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার উন্নত দেশগুলোতে হ্যারাসমেন্ট, হেটস্পিচ, ফলস ইনফরমেশন ও জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানো পোস্ট এবং ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা ভঙ্গের জন্য বিপুল অঙ্কের জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি ফেসবুক এবং গুগলকে ২১০ মিলিয়ন ইউরো জরিমানা করে ফ্রান্স সরকার। এর আগে ২০১৯ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র ফেসবুককে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জরিমানা করেছিল। অস্ট্রেলিয়া সে দেশে ফেসবুক-ইউটিউবের ব্যবসা পরিচালনার জন্য কঠোর আইন করেছে। আপত্তিকর পোস্টে রিপোর্ট করা হলে দ্রুত তা সরিয়ে না নিলে যে কোনো মুহূর্তে ফেসবুক বন্ধ রাখার ক্ষমতা সংবলিত আইন করেছে ভিয়েতনাম। এসব দেশে আইন করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ক্ষতিকর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক ব্যবহারকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু আমাদের দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার ক্ষেত্রে ফেসবুক, গুগলের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পরিবর্তে ব্যবহারকারীকে দায়ী করে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার স্বাধীনতা রাখা হয়েছে। এটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ক্ষতিকর ব্যবহারকেই বরং বাড়িয়ে তুলছে।

সামাজিক মাধ্যমের ক্ষতিকর ব্যবহারের উদাহরণ বারবার দেখছি। সেই রামুর উত্তম বড়ূয়া, নাসিরনগরের রসরাজ দাশ, দিনাজপুরের দীপ্তি রাণী, রংপুরের টিটু রায়, শাল্লার ঝুমন দাশ, কুমিল্লায় পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টা কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনায় বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও জেল খেটেছেন। এসবের দায় ফেসবুকেরও। ফেসবুক ব্যবহার করেই কেউ কেউ দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের নামে উদ্ভট, কাল্পনিক তথ্য দিয়ে ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।

অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে ফেসবুক কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড লঙ্ঘন করা পোস্ট দ্রুত সরিয়ে নিলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রমাণিত হেটস্পিচ, হ্যারাসমেন্ট ও ফলস ইনফরমেশন সংবলিত পোস্টগুলোর রিপোর্ট আমলে নিচ্ছে না। সবশেষ ফেসবুকের একটি তথ্য থেকেই দেখা গেছে- বাংলাদেশ থেকে যতগুলো পোস্টের ব্যাপারে রিপোর্ট হয়, তার মাত্র ২৫ শতাংশ তারা আমলে নেয়! বাকি ৭৫ শতাংশ কেন আমলে নেওয়া হয় না এর কোনো ব্যাখ্যা নেই।

একটি বিষয় পরিস্কার- ফেসবুক, ইউটিউব, অ্যামাজন যা-ই বলি না কেন, এগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যই তাদের অগ্রাধিকার। তাদের কাছে দেশভেদে সাধারণ মানুষের সম্মানহানি, মিথ্যাচার, ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়ানো প্রতিরোধের নীতিতে বৈষম্য দেখা যায়। ব্যবসার প্রয়োজনে ইউরোপ-আমেরিকায় তাদের কাছে হ্যারাসমেন্ট কিংবা হেটস্পিচের রিপোর্টের গুরুত্ব বেশি, আবার ব্যবসার জন্যই তারা বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে এ ধরনের কনটেন্টে রিপোর্ট আমলে নেয় না। কারণ বাংলাদেশের মতো দেশে তাদের ধরার মতো কোনো আইন নেই।

প্রশ্ন উঠতে পারে, ফেসবুক, ইউটিউবকে আইন দিয়ে ধরবেন কীভাবে? যদি আইনপ্রণেতাদের সদিচ্ছা থাকে তাহলে আইন দিয়েই ফেসবুক, গুগল নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। ব্যবসার প্রয়োজনে এসব বিদেশি কোম্পানি কিন্তু ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন করেছে। কনটেন্ট প্রকাশ ও প্রচারের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ফেসবুক, ইউটিউবের দায় এড়ানোর কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। অতএব, যে দেশে ব্যবসা করবে সে দেশের আইন অনুযায়ীই তা করতে হবে। ক্ষতিকর কনটেন্ট রিপোর্ট করার পরও সরিয়ে না নিলে ফেসবুক, ইউটিউবকে বড় অঙ্কের জরিমানার বিধান সংবলিত উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার আইন থাকতে হবে। শুধু পোস্টদাতাকে ধরতে হবে- এই চিন্তা না করে ফেসবুক, গুগলকে দায়বদ্ধ করার জন্য আইন করতে হবে। এগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান; বাংলাদেশেও এদের ব্যবসার পরিমাণ বিপুল। ব্যবসার প্রয়োজনেই এরা আইনের বিধান মানতে বাধ্য হবে।

আইন না থাকার কারণে ফেসবুক কীভাবে দায় এড়ায়, তার এক উদাহরণ দিই। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের জন্য একজন কর্মকর্তা নিয়োগ দেয় ফেসবুক। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এবার বাংলাদেশে ক্ষতিকর কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। বাস্তবে ফেসবুক বাংলাদেশে শুধু তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থই দেখছে। ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন করা এবং সরকারি পর্যায়ে কিছু প্রশিক্ষণ দেওয়া ছাড়া ব্যবহারকারীসহ সংশ্নিষ্ট অন্য অংশীজনের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা যায়নি।

বর্তমানে ফেসবুকের বাংলাদেশবিষয়ক কার্যক্রম পরিচালিত হয় তাদের সিঙ্গাপুর কার্যালয়ের মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী আইন করে ফেসবুকের বাংলাদেশবিষয়ক কর্মকর্তার বাংলাদেশে অবস্থান এবং বাংলাদেশেই অফিস পরিচালনা নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের দৃশ্যমান সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। স্থানীয় পর্যায়েই গ্রাহক অভিযোগকেন্দ্র থাকতে হবে। যেখান থেকে দ্রুততার সঙ্গে ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ কনটেন্ট সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। একই সঙ্গে ফেসবুক যেসব ফ্যাক্টচেকার নিয়োগ দিয়েছে তাদের পরিচয় প্রকাশ আইনের মাধ্যমেই নিশ্চিত করতে হবে। আইন না মানলে ফেসবুক, ইউটিউবের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। অপপ্রয়োগ, দমন বা অযাচিত নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার নয়; ফেসবুক-ইউটিউবের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোকে দায়বদ্ধ করার আইন করতে হবে। এ ধরনের আইনের কথা ভাববেন কি বাংলাদেশের আইনপ্রণেতারা?

রাশেদ মেহেদী: সাংবাদিক; সদস্য, বাংলাদেশ ইন্টারনেট ফ্রিডম ইনিশিয়েটিভ ওয়ার্কিং গ্রুপ