দেশের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নগরী ও বন্দরনগরী বলে খ্যাত চট্টগ্রামে নাগরিক সেবা কতটা উপেক্ষিত এবং সিটি করপোরেশন ও সংশ্নিষ্ট অন্য দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার চিত্র কত প্রকট তা-ই ফের উঠে এসেছে শুক্রবার সমকালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। চট্টগ্রামের অরক্ষিত খাল-নালায় এ পর্যন্ত প্রাণহানির ঘটনা অনেক ঘটলেও ওই অরক্ষিত স্থানগুলো নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে আজও সুরক্ষিত ও নিরাপদ করতে পারেনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। সমকালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাল-নালায় হতাহতের ঘটনায় সাত মাস আগে চিহ্নিত করা 'মৃত্যুফাঁদ' আজও জিইয়ে আছে। নগরবাসীর নিরাপত্তায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে চসিক ও সিডিএ। চসিকের হিসাব অনুযায়ী নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে খাল-নালা রয়েছে এক হাজার ১৩৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া খালের পাড় রয়েছে ১৯ কিলোমিটার। উন্মুক্ত চরম ঝুঁকিপূর্ণ নালা রয়েছে অসংখ্য। সহজেই প্রতীয়মান হয়, কী বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে নগরবাসীকে চলাফেরা করতে হচ্ছে।

সমকালের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে আরও কিছু বিপজ্জনক চিত্র। সামনে বর্ষা মৌসুম। আমরা দেখেছি সামান্য বৃষ্টিতেই চট্টগ্রাম নগরীতে কী ভয়াবহ দুরবস্থার সৃষ্টি হয়। বৃষ্টির পানিতে নালা-খাল-রাস্তা একাকার হয়ে যায়। জলাবদ্ধতা চট্টগ্রাম নগরীর পুরোনো সমস্যা। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে কিছু কাজ হলেও এর সুফল কার্যত দৃশ্যমান নয়। একের পর এক মৃত্যুতে উন্মুক্ত নালায় স্লাব ও খালে নিরাপত্তা বেষ্টনীর জোর জনদাবি সত্ত্বেও নির্বিকার কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী সমকালকে জানিয়েছেন, উন্মুক্ত খাল-নালায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার কাজ চলমান। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- 'হবে', 'হচ্ছে'র জটাজাল আজও ছিন্ন হয়নি কেন। শুধু রুটিন কাজেই দায় সারার অবকাশ নেই নগর কর্তৃপক্ষের। চট্টগ্রাম ওয়াসার সেবার মান ও ভূমিকা নিয়েও এর মধ্যে কম প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু বিস্ময়করভাবে দায়িত্বশীল সবাই যেন দায়হীন।

চট্টগ্রামের উন্নয়ন প্রকল্পে নগরবাসী আশায় বুক বেঁধেছিলেন বটে, কিন্তু দশক পার হয়ে গেলেও উন্নয়নের সুফল মেলেনি। প্রশ্ন আছে, চট্টগ্রামের কোনো কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়েও। যেখানে দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন, সেখানে তা না করে তুলনামূলক ভালো সড়কগুলোর সংস্কারের জন্য বরাদ্দ চাওয়া ও দেওয়া, উড়াল সড়কেও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বেহাল দশা নগরবাসীর জন্য আরও বহুমুখী ঝুঁকি ও দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রামের নালা-খালগুলো এখন কেন মৃত্যুকূপ হয়ে আছে, আর কত হতাহত হলে কর্তৃপক্ষের সম্বিৎ ফিরবে- এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায় যাদের, তারা নিরুত্তর থাকতে পারেন না। উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের কারণে নালা-নর্দমা-খাল আরও বিপজ্জনক হয়ে পড়ায় সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীলদের দক্ষতা-দূরদর্শিতা নিয়েও সংগতই প্রশ্ন দাঁড়ায়।

নাগরিক সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বঞ্চনার পাশাপাশি নগরবাসীর জীবন যে ঝুঁকির মুখে পড়েছে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এক একটি মর্মন্তুদ ঘটনার পর নানা মহলে শুরু হয় পর্যালোচনা আর করণীয়ের ব্যাপারে তোড়জোড়। আবার এক পর্যায়ে সবই মিইয়েও যায়। এরই খেসারত জীবন দিয়ে দিতে হচ্ছে নগরবাসীকে। প্রশ্ন উঠতেই পারে- হতাহতের ঘটনাগুলো দুর্ঘটনা, অবহেলা নাকি খুন? আমরা মনে করি, সরকারের দায়িত্ব সংশ্নিষ্ট সব পক্ষের জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং কেন এতদিনেও চট্টগ্রামের সাড় পাঁচ হাজারের বেশি মৃত্যুফাঁদ বন্ধ করা যায়নি তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া। খাল-নালা-নর্দমা অরক্ষিত থাকলে এবং সামান্য বৃষ্টিতেই যে নগরীতে পানি থইথই করে সেখানে জীবনযাত্রার পথ কতটা বিপদসংকুল তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই।

আমরা এও মনে করি, দায় যেখানে নির্দিষ্ট, সেখানে দায়িত্বশীল যে কারোর সময়ের কাজ সময়ে করতে না পারার জন্য যথাযথ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। নগরবাসী করের বিনিময়ে সেবাদানকারী কর্তৃপক্ষগুলোর সমন্বয়হীনতা আর একে অন্যের দোষারোপের কাদাজলে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার প্রত্যাশা বিসর্জন দিতে পারেন না। সরকারকে এ ব্যাপারে আশু মনোযোগ দেওয়া জরুরি।