হাওর বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশাল, বিস্তীর্ণ জলরাশির এক সীমাহীন প্রান্তরের ছবি। বর্ষায় সেই জলরাশির বিচিত্র রূপ। কখনও নিপাট নীরব নৈঃশব্দে ভরা সূর্যাস্তের সোনালি আভার রঙে ঢেউ খেলে যাওয়া, কখনও রুদ্ররোষে জেগে ওঠা আফালের বিরামহীন হুঙ্কার। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ৪০০ হাওর রয়েছে। ভূতাত্ত্বিক অবস্থান বা এলাকার বৈশিষ্ট্যভেদে হাওরকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়- ১. পাহাড়ের পাদদেশে বা পাহাড়ের কাছাকাছি অবস্থিত হাওর, ২. প্লাবিত এলাকায় হাওর, ৩. গভীর পানি এলাকায় হাওর।

বাংলাদেশে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ময়মনসিংহের গারো খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশ থেকে শুরু করে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সুনামগঞ্জ অর্থাৎ কুশিয়ারা-সুরমা অববাহিকার যে বিশাল নিম্নভূমি সেটাই হাওর অঞ্চল। রামসার সাইট টাঙ্গুয়াসহ বৃহত্তর সিলেট বিভাগের প্রধান হাওরগুলোর অবস্থান সুনামগঞ্জ জেলায়। সুনামগঞ্জকে তাই হাওরের রাজধানী বলা হয়। তার পরই মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার একাংশজুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাওরখ্যাত হাকালুকি হাওর। এ ছাড়া হবিগঞ্জেও অসংখ্য হাওর ও জলাশয় রয়েছে।

বৈশাখ শুরু হতে না হতেই উজানে প্রবল বৃষ্টিপাতে নদীগুলো দিয়ে পানি ঢুকছে এবং ফসলরক্ষা বাঁধগুলো একে একে ভাঙছে। প্লাবিত হচ্ছে বিভিন্ন কাঁচা ফসলে ভরা হাওর। এটা বছরের পর বছরের চিত্র। পৃথিবী বদলায় কৃষকের ভাগ্য ও নিয়তি বদলায় না। ফসল ঘরে উঠলেও তারা ন্যায্য দাম পান না। জলের দামে বিক্রি করে দিতে হয়। আর গোলায় ফসল না উঠলে তো দুর্দশার অন্ত থাকে না। বিশেষ করে ভাটি অঞ্চলে সারা বছরের খাবার ও খরচ আসে বোরো মৌসুমের এক ফসলি জমির ফসল থেকেই। বেঁচে থাকার সে অবলম্বনও প্রায়ই আকস্মিক উজানের ঢলে আর কান্নার জলে ভেসে যায়। প্রায় বছরই এভাবে ফসলহানি ঘটছে। এর জন্য আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী। দায়ী হাওরাঞ্চলে অপরিকল্পিত উন্নয়ন, পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া ইত্যাদি। জলের তোড়ে ভেসে যাওয়া বাঁধের পাশে বসা অসহায় কৃষকের কান্না, হাওরাঞ্চলে নিরুপায় কৃষকের বাঁধ নিয়ে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ ও আহাজারি কাউকে স্পর্শ করে কিনা জানি না। জলে শুধু ফসল ডোবে না, ফসলের সঙ্গে কৃষক পরিবারের বেঁচে থাকার স্বপ্ন ও সম্ভাবনাও ডুবে যায়। আমরা কেন্দ্রে বসে কালেভদ্রে রিমোট টিপে টিভিতে বা পত্রিকায় ভাসান পানি দেখি। কিন্তু ফসলের সঙ্গে কৃষক পরিবারের কত স্বপ্লের সলিলসমাধি হয় সে খবর রাখি না।

জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব ও হাওরাঞ্চলের ভবিষ্যৎ:

ক্রমাগত বিশ্ব উষ্ণায়নের মাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের বসবাসের পরিবেশ ও প্রতিবেশকে নিয়ত ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। একজন ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী বলেছেন, আমাদের সময়ের পরিবেশগত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ যদি সত্যি হয়, তাহলে উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে পরিবেশকে অর্থাৎ মানবগোষ্ঠীকে একের পর এক বিধ্বংসী ও ভয়ংকর পরিণতির সম্মুখীন করে তুলবে। আর এ বিধ্বংসী ফলাফল কোনো নির্দিষ্ট এলাকা নয় বরং বিশ্বব্যাপী অনুমিত হবে। তিনি আরও বলেছেন, উষ্ণায়নের ফলে ক্ষতিকর প্রভাবগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়া, বিশাল পরিমাণ উর্বর ভূমি মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা (যার মধ্যে হাওর পড়ে), মহামারি আকারে রোগ-বালাই বৃদ্ধি, ফসল উৎপাদন কমে যাওয়া। দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সমতল ভূমি, জলাভূমি, হাওর-বাঁওড় ফসল উৎপাদনের প্রধান ক্ষেত্র, বন্যা, খরা ও দুর্যোগ বৃদ্ধি (অকাল বন্যা ও খরা হাওরের মানুষের জন্য বিশাল হুমকি হিসেবে দেখা দেবে), ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি।

গিডেন্স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের এক রিপোর্টের বরাত দিয়ে বলেছেন, ‘বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষজন ব্যাপকহারে নিরাপদ এলাকায় অভিবাসন ও স্থানান্তর হবে।’ যা নিরাপদ এলাকার মানুষের জন্যও দুশ্চিন্তার বিষয়।

এসব বড় আকারের পরিবর্তন ও ঝুঁকির হুমকি ছাড়াও বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় ইতোমধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। যেমন, বাংলাদেশে প্রাপ্ত ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৩০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় মিঠাপানি বা হাওর অঞ্চলে। কিন্তু কীটনাশক, রাসায়নিক সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার বৃদ্ধি, পানির স্বাভাবিক প্রবাহে অপরিকল্পিত উন্নয়নের নামে বাধার ফলে মাছসহ অসংখ্য জলজ, প্রাণীজ উদ্ভিদের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন, বৃষ্টির পানি কমে যাওয়ার ফলে শুকনো মৌসুমে হাওরেও পানির পরিমাণ কমে গেছে, মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ব্যাহত, অতিবৃষ্টিতে হাওর পানিতে ভরে গেলেও পানি স্থায়ী না হওয়া, হাওরাঞ্চলের উদ্ভিদের সঙ্গে বৃষ্টির সম্পর্ক নিবিড়, স্বাভাবিক বৃষ্টি ব্যাহত হলে হিজল, করচ, বরুণসহ অন্যান্য উদ্ভিদ বিলীন হয়ে যাবে, বিচিত্র প্রজাতির পাখি তাদের খাদ্য ও আবাসস্থল হারিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। হাওর অঞ্চলে এক সময় গভীর জঙ্গল ছিল, সেখানে এখন ধু-ধু করছে উদাস হাওর।

হাওর রক্ষায় করণীয়:

১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ইরানের রামসা শহরে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পৃথিবীর জলাভূমি বিষয়ে আন্তর্জাতিক সনদ তৈরি হয়। রামসার এবং আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে। উল্লেখ্য, এতে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ স্বাক্ষর ও অনুমোদন রয়েছে। যা আলোচিত টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গেও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে কার্যকরী করা যায়। আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদের ১৪নং অনুচ্ছেদের 'ঘ' ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ আছে, 'চুক্তিবদ্ধ পক্ষরাষ্ট্রের আওতাধীন বা নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় সৃষ্ট কোনো কারণে যদি অন্য কোনো রাষ্ট্রের প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে তবে সম্ভাব্য ক্ষতির শিকার সে রাষ্ট্রকে তা অবিহিত করতে হবে এবং ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।'

এ ছাড়া রামসার সনদের ৫নং অনুচ্ছেদ উল্লেখ আছে, চুক্তিবদ্ধ পক্ষরাষ্ট্রগুলো রামসার সম্মেলন থেকে উদ্ভূত দায়-দায়িত্ব বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যা একাধিক রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানাজুড়ে বিস্তৃত এবং যেসব জলপ্রণালি এক বা একাধিক রাষ্ট্র ব্যবহার করে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রগুলো জলাভূমি এবং জলাভূমির উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল সংরক্ষণের জন্য বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নীতিমালা ও বিধান বাস্তবায়ন করবে।

এ ছাড়া নানা সময় পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো হাওর রক্ষায় উল্লেখযোগ্য সুপারিশ হলো:

হাওর এলাকায় প্রাণপ্রবাহ হিসেবে চিহ্নিত নদী ও খালগুলো খনন করা, হাওরে পানির স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ করে যত্রতত্র রাস্তা ও অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ, বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় মানুষের সম্মিলিত পরামর্শে নির্ধারিত সময়ে বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন ও প্রয়োজনমাফিক উঁচু করতে হবে, মিঠাপানির মৎস্যসম্পদ (অনেক বিলুপ্তপ্রায় মাছ ও জলজসম্পদ) রক্ষার্থে হাওরের বিলগুলোর সরকারি ইজারা পদ্ধতি সংস্কার করতে হবে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের দুর্নীতির মহোৎসব, দায়িত্বে গাফিলতি ও উদাসীনতা বন্ধ করে নজরদারি বাড়াতে হবে, হাওর এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়ন বৃদ্ধি ও সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিধি বাড়াতে হবে, একমাত্র নির্ভরশীল ফসল ধান চাষের বাইরে বিকল্প কৃষিশিল্প অর্থনীতি ও নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, হাওর ও বিল সংলগ্ন এলাকায় খাসজমি বরাদ্দ বন্ধ করে সরকারিভাবে স্থানীয় জলজ উদ্ভিদ ও বৃক্ষের সমারোহে সবুজায়নের উদ্যোগ নেওয়া দরকার, কেননা ফসলের বাইরেও হাওরাঞ্চলে প্রাণ ও প্রকৃতির একটা বিশাল জগৎ আজ বিপন্নপ্রায়, হাওর উন্নয়ন বোর্ডকে আরও সক্রিয় ও গতিশীল করতে হবে, হাওর উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, প্রয়োজনে হাওর উন্নয়নে পৃথক একটি মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে। যেখানে হাওরের মানুষ ও জনপ্রতিনিধিদের যোগ্য নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ থাকবে। কৃষকের কাঙ্ক্ষিত সেই পৃথিবী আজও আসেনি। রক্ত পানি করা শ্রমে ফলানো ফসল হারানোর রোদন কী কাউকে স্পর্শ করে?