হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, তখনকার ঘটনা। কলকাতা দাঙ্গা-বিধ্বস্ত শহর; চারদিকে প্রবল উত্তেজনা। এর মধ্যে কিছু লোক তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন সকাল বেলা। তারা খুবই উত্তেজিত। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতেই হবে। তখন সচিব এসে বললেন, এক ঘণ্টার আগে তিনি দেখা করতে পারবেন না। ওই লোকদের মধ্যে তার দলের গুরুত্বপূর্ণ কর্মীরাও আছেন। তারা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। জানালেন, আমরা তার কর্মী; আমাদের এখনও এক ঘণ্টা দেরি করতে হবে? তার সঙ্গে জরুরি কথা আছে আমাদের। সচিব বললেন, আপনাদের যত জরুরি কাজই থাকুক; তিনি এক ঘণ্টার আগে দেখা করবেন না। কারণ তিনি আরও একটি জরুরি কাজ করছেন এবং এ কাজটি তিনি প্রতিদিন সকালে করেন। তখন উত্তেজিত কর্মীরা বললেন, কী কাজ জানতে পারি? সচিব তখন বললেন, হ্যাঁ জানতে পারেন। তিনি খবরের কাগজ পড়ছেন। এ সময়ে তিনি কারও সঙ্গে দেখা করেন না, ফোনও ধরেন না। আপনারা বসুন, পত্রিকা পড়া শেষ হলে আপনাদের ডাকব।
একবার এক জরুরি প্রয়োজনে বাংলাদেশের এককালের প্রখ্যাত আমলা এবং সচিব আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম; সেটাও ঠিক সকাল বেলায়। তার একান্ত সচিব বললেন, স্যার পত্রিকা পড়ছেন। পত্রিকা পড়া শেষ না হলে তিনি কারও সঙ্গে দেখা করেন না। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা পাকিস্তান আমলে প্রতিদিন সময় ধরে নিজের বাড়িতে, অফিসে বা জেলখানায় এই খবরের কাগজটা নিয়মিত পড়তেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা শুধু পড়তেন না; লাল-নীল কালি দিয়ে পত্রিকায় দাগ দিয়ে রাখতেন। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ভোর হওয়ার আগেই খবরের কাগজের কাটিং মন্ত্রী-সচিবদের বাড়িতে চলে যেত। এখন যায় কিনা জানি না, তবে ফলাফল শূন্য। এখন সম্ভবত মন্ত্রী-সচিবরা ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন সেলফোনে। তারপর অফিসে এসে চলে যান নানা মিটিংয়ে। এর মধ্যে হাজারো তদবির এবং নিজের তদবির। এই করতে করতে কখনও রাত ১২টা থেকে ১টা বেজে যায়! এত ব্যস্ততার মধ্যে কোনো একটি বিশেষ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমরা খবরের কাগজে অনেক কিছু লিখি, অনেক সংবাদ ছাপা হয়। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যেসব বিষয়ে নির্দেশনা দেন সেগুলো ছাড়া অন্যান্য বিষয় উপেক্ষিত থাকে। অথচ সেই বিষয়গুলোতে রাষ্ট্রের টাকা, জনগণের স্বার্থ অনেক কিছুই থাকে। এক সময় পত্রিকার একটি লেখা দেখলে মন্ত্রীরা লেখককে চিঠি লিখতেন অথবা আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানাতেন। সেসব সংস্কৃতি আজ আর নেই। এ জন্যই আমরা যারা লিখি তাদের কখনও মনে হয়, লিখে কোনো লাভ হয় না। তবু লিখি এবং সেই লেখা সাধারণত পাঠক পড়েন।
সেই ব্রিটিশ আমল থেকে প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট বলে একটি বড় সরকারি দপ্তর আছে। তাদের কাজই হচ্ছে প্রেসের সঙ্গে সরকারের একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখা। এই দপ্তরের কর্মকর্তারাই বিভিন্ন মন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়ে থাকে। সেখানে মন্ত্রীর জনসংযোগের কাজটাই তার কাছে মুখ্য; মন্ত্রীর সংবাদগুলো পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করার মাঝেই তার কৃতিত্ব। বহুদিন ধরে প্রায় সব পত্রিকাতে প্রাইমারি শিক্ষকদের নিয়োগ বাণিজ্যের কথা উঠে এসেছে। ৪৫ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হবে জেনে এ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দালালচক্র ভীষণভাবে মুখিয়ে আছে। জেলার সংসদ সদস্য এবং তাদের চ্যালা-চামুণ্ডারা এই কোটি কোটি টাকার বাণিজ্যের জন্য বসে আছেন। পরীক্ষাকেন্দ্রে যারা পরিদর্শক তারাও নকলের জোগান দিয়ে এই নিয়োগ অপরাধে যুক্ত হয়েছেন। তারাও শিক্ষক এবং লাখ লাখ টাকা খরচ করে চাকরি পেয়েছেন। এবার পরীক্ষার সময়ে এ ধরনের কাজ করতে গিয়ে বেশ কিছু দুর্বৃত্ত গ্রেপ্তারও হয়েছে। যার মধ্যে ছাত্রলীগের নেতারাও আছে। শিক্ষক নিয়োগে এ ধরনের দুর্বৃত্তায়নের ফলে আগামী ৩০ বছরের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য এরা উঠেপড়ে লেগেছে। যাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে তাদের বলা হচ্ছে খাতায় কিছু না লিখতে। এই না লেখা খাতাগুলো পরিদর্শকরা গ্রহণ করে থাকেন এবং পরবর্তীকালে ওই দুর্বৃত্তদের কাছে চালান করে দেন। তারা সেই সাদা খাতাগুলো পূরণ করে যথাস্থানে পৌঁছে দেয়।


প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং স্বয়ং মন্ত্রী কি জানেন যে, এভাবে চাকরি হয়? একটু গোয়েন্দাদের কাজে লাগান। এই কাজে, পরীক্ষার্থীদের কাছে খোঁজ নিয়ে দেখেন তাদের ফোনে কতগুলো প্রশ্ন গেছে। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী পরীক্ষার হলে পরিদর্শনে গিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে বলে দিলেন, সব ঠিক চলছে; ওগুলো গুজব! অনেক পরীক্ষার্থী ভালো পরীক্ষা দিয়ে হল থেকে বেরিয়ে দুঃখ করে বলেছে, পরীক্ষা ভালো দিয়েছি; কিন্তু চাকরি তো হবে না! চাকরি যারা পাবে তারা ইতোমধ্যে টাকা দিয়ে দিয়েছে। মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হচ্ছে, এই পাঁচ থেকে বারো বছর বয়স পর্যন্ত। কালো শ্নেটে যেমন চক দিয়ে লিখলে সুন্দর করে শব্দগুলো বসে যায়, তেমনি কোমলমতি শিশুদের মস্তিস্কেও শিক্ষণীয় বিষয়গুলো গভীর রেখাপাত করে। টাকা-পয়সা ঘুষ দিয়ে যারা শিক্ষক হবেন তারা স্কুলে গিয়েই একজন আপনজন খুঁজে পাবেন। যিনি ওই এলাকার কোচিং থেকে শুরু করে প্রশ্ন ফাঁস এবং দোকানদার সমিতিরও সদস্য। এই নতুন শিক্ষককে নানাভাবে উজ্জীবিত করে শিক্ষাকে বাদ দিয়ে নানা লাইনে ঢুকিয়ে দেবে। কারণ চাকরি পেতে যে ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, তা তুলতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি অনুগ্রহ করে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের সম্পদের একটা তদন্ত করবে?
একজন শিক্ষক যদি দোকানদারি করেন, মাঠে মাঠে গরু-ছাগলের ব্যবসা করেন, তাহলে তার পক্ষে প্রকৃত শিক্ষা দেওয়া কি সম্ভব? আমি এখনও বুঝতে পারি না- সরকার কোন স্বার্থে কোচিং সেন্টারগুলো বাঁচিয়ে রাখছে? কেন অবিলম্বে এগুলো বন্ধ হচ্ছে না? একবার এক সচিব ও মন্ত্রী সমস্বরে চিৎকার করছিলেন, শিক্ষার ব্যাপক অগ্রসর হয়েছে। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে বলেছিলাম, শিক্ষা যদি শুধু অক্ষরজ্ঞান হয় তাহলে আপনাদের কথা ঠিক আছে। কিন্তু যদি প্রকৃত শিক্ষার কথা বলেন তাহলে আপনাদের এই বক্তব্য সম্পূর্ণ মিথ্যে। প্রকৃত শিক্ষাই যদি হতো তাহলে নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ছাত্রদের মারামারি হতো না। ছাত্ররা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে যুক্ত হতো না। একেবারেই কোমলমতি ছাত্ররা শিক্ষককে অবমাননার জন্য উঠেপড়ে লাগত না। আবার শিক্ষকরাও ভালো একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রদের লেলিয়ে দিতেন না। একটি সচেতন লোকও বলবে না- শিক্ষাটা ঠিকমতো হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষার তদারকিতে থানা থেকে জেলা পর্যন্ত যারা থাকেন তারা কী করেন? আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, স্কুলশিক্ষকদের নানা রকম হয়রানিতে তারা সময় কাটান। কিন্তু সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। উচ্চ তদারকিতে যারা আছেন তারাও নানাভাবে এই দুর্নীতিগ্রস্ত অবস্থাকে সাহায্য করে আসছেন। আমি জানি না, এই লেখা প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের কেউ পড়বেন কিনা! আমি যদি অসত্য বা আপত্তিকর কিছু লিখে থাকি তাহলে অবশ্যই প্রতিবাদ করবেন। কিন্তু আমি জানি, প্রতিবাদ করার সাহসও আজকের দিনে বড় অভাব। দোহাই দিয়ে বলছি, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যারা আছেন তারা যেন আগামী ৩০ বছরের শিক্ষার মেরুদণ্ডকে ভেঙে চুরমার করে দেবেন না।
মামুনুর রশীদ: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব