
ফাঁসির মঞ্চে ওঠার আগে আগস্ট স্পিজ নামে এক শ্রমিক বলেছিলেন, 'আজ আমাদের নিঃশব্দতা তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা এক দিন অধিক শক্তিশালী হবে।' আগস্ট স্পিজের সেই বাণী সত্যি হয়েছে। ক’দিন পরই ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। পৃথিবীর ৮০টি দেশে এখন মে দিবস পালিত হয়। উচ্চারিত হয় শ্রমিক অধিকারের দাবি, যে শ্রমিক সভ্যতা বিনির্মাণের মূল কারিগর। ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর শিকাগো শহরে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ৬ শ্রমিককে। তার আগের দিন আরেক শ্রমিক লুইস লিং আত্মহননের পথ বেছে নেন। পুঁজিবাদী আমেরিকার বিচার ব্যবস্থায় প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলে মৃত্যুবরণের চেয়ে নিজেকে মেরে ফেলাই উত্তম মনে করেছিলেন লুইস লিং।
এ ঘটনার আগে ১৮৮৬ সালের মে মাসের ১-৩ তারিখে আমেরিকার শিকাগো, উইসকনসিন, নিউইয়র্ক শহরে ফেডারেশন অব অর্গানাইজড ট্রেডস অ্যান্ড লেবার অর্গানাইজেশনের উদ্যোগে সারা আমেরিকায় ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে ডাকা হয়েছিল শ্রমিক ধর্মঘট। সেই সময়ে দৈনিক মাত্র দেড় ডলারের বিনিময়ে শ্রমিকদের কাজ করতে হতো মালিকের ইচ্ছানুযায়ী। ১০-১২ ঘণ্টা তো এমনিতেই; কখনও তা পৌঁছে যেত ১৫-১৬ ঘণ্টায়। দেড় ডলারের বিনিময়ে ঠিক কত ঘণ্টা কাজ করতে হবে, তা নির্ধারণ করত শিল্পের মালিক। শ্রমিকের কোনো সুযোগই ছিল না শ্রমঘণ্টা নির্ধারণের। এরও আগে ১৮৮৪ সালের অক্টোবর মাসে প্রতিষ্ঠিত ফেডারেশন অব অর্গানাইজড ট্রেডস অ্যান্ড লেবার অর্গাইনাইজেশন শ্রমঘণ্টা ৮ ঘণ্টা করার দাবি জানিয়ে আসছিল। এই শ্রমিক সংগঠনই দুনিয়াতে প্রথম ৮ ঘণ্টা শ্রমঘণ্টা করার দাবি উত্থাপন করে। পুঁজিবাদী মালিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার শ্রমিকদের এই ন্যায্য দাবি মেনে নিতে বরাবরই অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিল।
১৮৮৬ সালের ১-৩ মে শিকাগোসহ আমেরিকার বড় বড় শহরে শ্রমিকরা নেমে এসেছিল রাজপথে। ৩ মে পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ ছিল সেই শ্রমিক ধর্মঘট ও শ্রমিক সমাবেশ। ৪ তারিখে শিকাগোর হারভেস্টিং মেশিন কোম্পানির সামনে সমবেত শ্রমিক দের ওপর মার্কিন পুলিশ গুলি চালায়। এতে নিহত হয় দুই শ্রমিক; আহত হয় শত শত। পরদিন ৫ মে তারিখে শিকাগোর হে মার্কেট স্কয়ারে শ্রমিক সমাবেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ গুলি চালালে নিহত হয় আরও ৭ জন শ্রমিক। অজ্ঞাত ব্যক্তির ছুড়ে দেওয়া বোমায় নিহত হয় ৪ পুলিশ সদস্য। পুলিশ হত্যার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয় ৮ শ্রমিককে। তাদের মধ্যে ৭ জনকে দেওয়া হয় প্রকাশ্যে ফাঁসির আদেশ; একজনকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড। তারপরও পুঁজিবাদের রক্ষক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারগুলো দাবি মেনে নেয়নি।
১৮৮৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর ওয়ার্কার্স অ্যান্ড সোশ্যালিস্ট আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে ১ মে পালন করতে থাকে। ৩০ বছর পর ১৯১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ৮ ঘণ্টা শ্রমঘণ্টা আইন প্রণয়ন করে এবং ১৯১৭ সালে তা বাস্তবায়িত হয়।
১৯১৭ সালে ভদ্মাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত রাশিয়ায় দুনিয়ায় প্রথম শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে 'মে দিবস' পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিাভন্ন দেশে পালিত হতে থাকে মে দিবস। এই দিনে পৃথিবীর ৮০টি দেশে শ্রমিক সংগঠনগুলো বের করে শোভাযাত্রা। উচ্চারিত হয় শ্রমিক অধিকারের দাবি। শিকাগো শহরে আত্মাহুতি দেওয়া শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ভারতবর্ষে মে দিবস পালনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে সমাজতন্ত্রীরা। এ সময়ে ভারতবর্ষে গড়ে ওঠা শিল্পের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে। কলকাতায় শ্রমিক আন্দোলনে ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, জ্যোতি বসু, মণি সিংহ প্রমুখ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৩০ সালের ১ মে কলকাতায় শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে বিশাল শ্রমিক সমাবেশ ও মিছিল সংগঠিত হয় এবং তার পরপরই বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হলে ৯ মে তারিখে মণি সিংহসহ বেশ কয়েকজন শ্রমিক আন্দোলনকারী গ্রেপ্তার হন।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাট ও বস্ত্র খাতে পাকিস্তানি পুঁজিপতিরা এদেশে শিল্প স্থাপন করেন। এ শিল্পের কাঁচামাল ও শ্রমিক দুটোই ছিল এ অঞ্চলের। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মে দিবস পালন অসম্ভব হয়ে যায়। নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলতে থাকেন। এক সময় পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধিকার আন্দোলন সূচিত হলে শ্রমিক আন্দোলন সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। '৬২-এর ছাত্র আন্দোলনের পরপরই শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত হয় এবং এ সময় ছাত্র আন্দোলনের সংগঠকদের ছাত্রত্ব শেষে শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ১৯৬৬ সালে স্বায়ত্তশাসনসহ ৬ দফা আন্দোলনে ৭ জুন যে হরতাল আহ্বান করা হয়, সে হরতালে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক মনু মিঞা গুলিতে মারা যান। এক পর্যায়ে স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনের যোগসূত্র সৃষ্টি হয়। এ সময় মে দিবস পালন জোরদার হয়ে ওঠে। '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় ৬ দফার সঙ্গে শ্রমিক-কৃষকের ১১ দফা দাবি যুক্ত হলে শ্রমিক-কৃষক ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে- এমন বিশ্বাসে আশ্বস্ত হয়। ফলে শ্রমিকরা গণআন্দোলনে যুক্ত হয় এবং বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। '৬০-এর দশকে ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করতে মোহাম্মদ ফরহাদ, কাজী জাফর আহমদ, সিরাজুল আলম খান, মতিয়া চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, শামসুদ্দোহা, আব্দুল্লাহ সরকার, মোর্শেদ আলীসহ তরুণ ছাত্রনেতারা যুক্ত হন। তাদের ভেতর অনেককেই পরবর্তী সময়ে জাতীয় শ্রমিক আন্দোলনের প্রথম সারিতে দেখা গেছে। মূলত সমাজতন্ত্রের মতাদর্শে দীক্ষিত হয়েই এ প্রজন্ম জাতীয় শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। কিন্তু '৭৫-পরবর্তী সরকারগুলো শিল্পের রাষ্ট্রায়ত্তকরণের নীতিমালা থেকে সরে আসে। শিল্প-কারখানাগুলো লোকসান গুনতে থাকে, যার পুরোটার দায়-দায়িত্ব শ্রমিকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। শ্রমিক সংগঠনগুলোতে আদর্শবাদিতার ধারা সংকুচিত হতে থাকে। ছাত্র আন্দোলনের মতোই শ্রমিক আন্দোলনে অবৈধ অর্থ আর অস্ত্রের ঝনঝনানি বৃদ্ধি পায়। সব রাজনৈতিক দলই শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলে। স্বাধীন শ্রমিক আন্দোলন ও শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বদলে জাতীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়ে পরিস্থিতি এখন এমন, ক্ষেত্রবিশেষে মালিকরাই অনেকে শ্রমিক নেতা হয়ে গেছেন।
একটা চরম বৈষম্যমূলক সমাজে আমাদের বসবাস। যেখানে শ্রমিক তার কারখানায়ও অনেক ক্ষেত্রে নিরাপদ নয়। শ্রমঘণ্টার বালাই নেই। নূ্যনতম মজুরি সরকার কর্তৃক যা অনুমোদিত তা অমানবিক। আট হাজার টাকায় একজন শ্রমিকের সংসার চলে? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উৎসবে বেতন-বোনাস নিয়ে জটিলতা হয়। শ্রমিকের সন্তানের জন্য শিক্ষার সুযোগ নেই। নেই তাদের চিকিৎসার উপযুক্ত ব্যবস্থা। যে শ্রমিক পোশাক তৈরি করে; উৎসবে তার সন্তানের পোশাকই সে ক্রয় করতে অক্ষম। শুধু পোশাক খাত নয়; পাট, বস্ত্র, চামড়া, নির্মাণ, সড়ক, নৌ- সব খাতের শ্রমিকের একই অবস্থা। অসংগঠিত হিসেবে বহু শ্রমিক আছে আমাদের দেশে, যাদের সংখ্যা কোটির ওপরে। তারা দিনমজুর। তাদের জন্য কোনো কিছুই নেই শ্রমিক-কৃষকের রক্তের ওপর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে।
মহান মে দিবসের একটা তাৎপর্য আছে। মে দিবস শ্রমিককে তার ন্যায্য পাওনা আদায়ে আন্দোলিত করে। মে দিবস শ্রমিককে তার ওপর পুঁজির শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিদ্রোহে জাগ্রত করে।
আমরা স্বাধীন শ্রমিক আন্দোলনের পক্ষে। যে আন্দোলনে মালিকের কাছ থেকে শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা আদায় করে নেবে। যে আন্দোলন শ্রমিককে রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কিংবা ক্ষমতায় থাকার জন্য ব্যবহার করবে না। যেখানে মালিক-শ্রমিকের দ্বন্দ্ব্বের পাশাপাশি সহাবস্থান থাকবে। গ্রামের জনগণই সর্বস্ব হারিয়ে এক দিন শিল্পের শ্রমিক হয়। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য শ্রম বিক্রি করে আয় করা ছাড়া যার কোনো উপায় থাকে না, সেই হয় সর্বহারা শ্রমিক।
শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে আমাদের বিবেককে জাগ্রত করি। শ্রমিকের বেঁচে থাকার নূ্যনতম অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক, আমরা সে প্রত্যাশাই করি। পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ- বিশ্বসভ্যতা বিনির্মাণ করেছে শ্রমিক। শ্রমজীবী সেই মানুষদের প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন।
মন্তব্য করুন