ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

ঈদের স্মৃতি, কলকাতায়

ঈদের স্মৃতি, কলকাতায়

প্রতীকী ছবি

দাউদ হায়দার

প্রকাশ: ০২ মে ২০২২ | ০৮:১১ | আপডেট: ০২ মে ২০২২ | ০৮:১১

মাসে দেড়শ রুপি খরচ করার মুরোদ নেই, অর্থাৎ প্রতিদিন পাঁচ। তিন রুপিতেও ক্ষিধে মেটে, কিন্তু মন বলে খাই খাই। চোখের খাওয়া আরও বেশি। থরেবিথরে সাজানো। রেস্তোরাঁয়, রেস্তোরাঁর সামনে খোলা চত্বরে। ম ম করছে গন্ধ, বাতাসে। রাস্তার ধুলোও গন্ধময়। কলকাতার সব অঞ্চলে নয়, বিশেষ কিছু এলাকায়। মুসলিম ঘন মহল্লায়। তাও আবার ভাগ ভাগ। বিভাজন এলাকাভিত্তিক। নাখোদা মসজিদ, চাদনিচক, নিজাম রেস্তোরাঁর আশপাশে (নিউমার্কেটের পেছনে)। পার্ক সার্কাস, রাজাবাজার, মেটিয়াবুরুজ, খিদিরপুর, চিৎপুরে (মসজিদের আশপাশে) জমজমাট ব্যবসা। রোজার মাসে। ইফতারির সময়। নানা জাতের খুরমা (খেজুর), বেদানা, আঙুর, আনারস, আপেল তো আছেই, হরেক স্বাদের শরবত। কাবাবের (বিফ) রকমফের চার ভাঁজের পরোটা ফিরনি, দই, মিষ্টি, লাচ্ছি। ঘুমনি। হালিম। কষা মাংশ (বিফ) গরম গরম।

রোজার মাস, জমজমাট খাওয়া। রেস্তোরাঁয় বসে কিংবা দাঁড়িয়ে। ফুটপাতে। প্লেটে নিয়ে। কষা মাংস। দুটি পরোটা। শিককাবাব দুটি। এক বাটি হালিম। এক বাটি ঘুমনি। আটটি খুরমা। গোটা দশেক আঙুর। একটি আপেলের হাফ। ছয়টি পেস্তা বাদাম। গুনেগেথে বারোটি কিশমিশ। একশ গ্রাম ফিরনি। একশ গ্রাম মিষ্টি দই। দুটি মিষ্টি। এক প্লেট পাঁচ রুপি। একটি পরোটা, একটি শিককাবাব, হাফ প্লেট কষা মাংস, চারটি পেস্তা বাদাম, একটি কমলালেবু হাফ, আটটি কিশমিশ, একটি মিষ্টি, পঞ্চাশ গ্রাম ফিরনি, পঞ্চাশ গ্রাম মিষ্টি দই, দাম তিন রুপি। হালিম ও ঘুমনি বাদ। মাথায় টুপি থাকলে দুই ফোঁটা আতর এবং এক চিলতে (নখের আঙুলে যতটুকু ওঠে) ফ্রি। মসজিদে গেলে, ইফতারের আগে, নামাজের সময়।

ইফতার বিনে পয়সায় (মসজিদে), ইফতার চলাকালীন আবারও বিতরণ। কে হিন্দু কে মুসলমান জিজ্ঞেসও করে না।

দেখেছি, নাখোদা মসজিদের চত্বরে বহু ভিখারি, ফুটপাতের বাসিন্দা, মজুর, বেকার, অভুক্ত ভবঘুরের ভিড়।

একবার শুনি এক বেকার ইফতারি খেয়ে বলছে সারাদিন খাওয়ার জোটে না। হে ইশ্বর সারাবছরই রোজার মাস করে দাও। ১৯৭৪ সালের কথা বলছি। যা দেখছি। শুনেছি। এখনকার চিত্র অজানা।

কলকাতার কসমোপলিটান। নানা চিত্র। নানা বাহানা। নানা উৎসব। ধর্মীয় পরব। ছট পুজো থেকে শুরু করে চীনা নববর্ষ। যিশুদিন যিশু-খ্রিষ্টবর্ষের শুরু (রাত বারোটার পরে), হ্যাপি নিউ ইয়ার, কলকাতার একশ্রেণির উঠতি ধনীর উন্মাদনা, হুল্লোড়। পহেলা বৈশাখ নয়।

খ্রিষ্টবর্ষকে কেন,'ইংরেজি নববর্ষ' বলে, মগজে ঢোকে না। ইংরেজিভাষী ব্রিটেনের বাইরেও, ইউরোপসহ নানা দেশে খ্রিষ্টবর্ষের শুরু।

ভারত ইংরেজের গোলামি করেছে প্রায় দুইশ বছর। গোলামিত্ব এখনও।

ফরাসি লেখক দ্যোমিনিক লেপেয়ার বলেছেন, কলকাতা 'আনন্দনগরী' (সিটি অব জয়)। আনন্দ এখন কতটা বিনয় ঘোষ বেঁচে থাকলে গভীর সমাজতত্ত্বের ঘটনাপ্রবাহের সমাজ রাজনীতির আকারবিকারের, দেশীয় ও বৈশ্বিক মনমেজাজের পরিবর্তন বিশ্নেষণ করতে পারতেন।

কলকাতায় যৌবন নানা রঙের। এক যুগের বেশি। বন্ধুকুল ধর্মে হিন্দু। থোড়াই কেয়ার। হিন্দু-মুসলিমের ফারাক স্পর্শ করেনি। পড়েছি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য।

সহপাঠী/পাঠিনীকুলে সৌমেন মণ্ডল (খ্রিষ্টান) তৃপ্তি বসু (ঘটক)। সোনালি রায়। কোয়েলি সেন (ঘোষ)। প্রশান্তকুমার সামন্ত। রঞ্জিত শূর। মিনাক্ষী সেনগুপ্ত (চৌধুরী)। সুচরিতা গুহ। সরস্বতী শেখের (নারায়ণ), নূপুর বিশ্বাস ফুলু (শ্রাবণী), অরুন্ধতী সেনগুপ্তর বাড়িতে গিয়ে 'মাসিমা মালপোয়া খামু।'

'অনেক খেয়েছিস, ঈদে খাওয়াবি না?' বন্ধুদের আবদারই নয় শুধু। ইইএসআইএস (এখন আমেরিকান সেন্টার)-এর কালচার বিভাগের কর্তা সুপ্রিয় বন্দোপাধ্যায় : 'মেনুতে কী আছে?'

অরুণ বাগচী (আনন্দবাজারের নিউজ এডিটর। পরে সহকারী সম্পাদক) : 'তোমার রান্নায় ঝাল কি বেশি?'

মৃণাল সেন : 'পদ্মার ইলিশ নেই?' মৃণাল সেনের স্ত্রী গীতা :'দইমাংস থাকবে?' ইরা চক্রবর্তী (কবি বিষ্ণু দের বড়কন্যা) : 'কচি পাঠার মাংস কষাবি।'

ঈদ অনুষ্ঠানের খরচ অন্নদাশঙ্কর রায়ের। লীলা রায় : 'আজ আমি স্পেশাল সালাদ করব।'

থাকি অন্নদাশঙ্কর রায়ের যৌধপুর পার্কের বাড়িতে। ঈদের পহেলা আয়োজন। যোধপুর পার্ক ছেড়ে বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে এসে আরও জাঁকজমক খাওয়া-দাওয়া। ঈদে। আরও অতিথি। স্বরাষ্ট সচিব রথীন সেনগুপ্ত বললেন :'তোর পাবনার স্পেশাল মেনু নেই?'

বললুম :'বরিশালের গুয়ামৌরি পান আছে (রথীনের আদি বাড়ি বরিশাল। রথীন পরে পশ্চিমবঙ্গের চিফ সেক্রেটারি)।' ঈদ সার্বজনীন।

আরও পড়ুন

×