- মতামত
- শ্রীলঙ্কার সংকটে বিশ্বসম্প্রদায় নির্লিপ্ত থাকবে?
প্রতিবেশী
শ্রীলঙ্কার সংকটে বিশ্বসম্প্রদায় নির্লিপ্ত থাকবে?

শ্রীলঙ্কায় চলছে গভীর রাজনৈতিক সংকট। প্রায় শতভাগ শিক্ষিত ও মানব উন্নয়ন সূচকে অগ্রগামী শ্রীলঙ্কায় সম্প্রতি যে সহিংসতা দেখছি, তা অকল্পনীয়। সেখানে কয়েক দিনের বিক্ষোভে অন্তত আটজন নিহত হয়েছে। এক আত্মঘাতী খেলায় মেতে উঠেছে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিক ও তাদের উগ্র সমর্থকরা। সেখানে বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগ করেছেন। মঙ্গলবার বিক্ষোভের মুখে মাহিন্দা রাজাপাকসেকে সরকারি বাসভবন ছাড়তে হয়েছে সেনা পাহারায়। তার আগে বিক্ষোভকারীরা বাসভবনের মূল ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে। তারা রাজধানীর 'টেম্পল ট্রিজ' বাসভবনের মূল দোতলা ভবনে হামলার চেষ্টা করে। শ্রীলঙ্কার এ বিক্ষোভের নানাবিধ মাত্রা রয়েছে।
আমরা জানি, মাহিন্দা রাজাপাকসের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার দীর্ঘ। ২০০৫ সালের নভেম্বরে মাহিন্দা শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টির প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। এর পর তিনি সেখানকার লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলম (এলটিটিই) সংকটে মনোযোগ দেন। তার পূর্বসূরিরা ব্যর্থ হলেও তামিলদের সঙ্গে ৩০ বছর ধরে চলা রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শ্রীলঙ্কার মানুষের কাছে নায়ক হয়ে ওঠেন মাহিন্দা রাজাপাকসে, যা তাকে ২০১০ সালের বড় জয়ে সাহায্য করে। ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকাকালে মাহিন্দা তার অবস্থানকে আরও সুসংহত করেন। ২০১৫ সালের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। তারই মন্ত্রিসভার সদস্য মৈত্রীপাল সিরিসেনা তাকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট হন। ২০১৯ সালে তার ভাই গোটাবায়া শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মাহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন।
শ্রীলঙ্কায় বর্তমানে যে বিক্ষোভ আমরা দেখছি, সেটি বলা চলে সেখানকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট যখন চরমে, তখন সে সংকট নিরসনে সরকারের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার পরিবর্তে তারা যে ধরনের আচরণ করছে, তাতে এটা অস্পষ্ট নয়- সংকট থেকে তারা বরং এক ধরনের ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। দেশটির জাতীয় স্বার্থ বিক্ষোভকারীদের ইন্ধনদাতাদের কাছে গৌণ। এমনিতেই শ্রীলঙ্কায় অন্তত গত এক দশকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন বিভাজন তৈরি হয়েছে; নাগরিকদের মধ্যেও তার প্রভাব আমরা দেখেছি।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান সংকটের পেছনে দেশটির ভূরাজনৈতিক অবস্থানও অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে। শ্রীলঙ্কা নিয়ে পরাশক্তি ও বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে এক ধরনের খেলা চলছে। শ্রীলঙ্কায় এক সময় ভারতের প্রভাব ছিল। শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মধ্যে দশকের পর দশক দারুণ সম্পর্ক ছিল। সে সূত্র ধরেই মার্কিন বলয়ে ছিল শ্রীলঙ্কা। এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব বাড়ার পর থেকেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, এমনকি তারপর ডোনাল্ড ট্রাম্পও, বিশেষ করে এশিয়া অঞ্চলে বিশেষ দৃষ্টি দেন। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর এ দৃষ্টির কারণেই শ্রীলঙ্কার অবস্থান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবে মাহিন্দা রাজাপাকসে যেভাবে সামরিক বাহিনীর সহায়তায় তামিলদের দমন করেন, সেখানে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতির কারণে পশ্চিমা চাপ বাড়তে থাকে। এটিকে একটি কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তখন মাহিন্দা রাজাপাকসে চীনমুখী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেন।সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্রীলঙ্কা অনেকটা চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে চীন যেভাবে বিনিয়োগ করে; সেভাবে শ্রীলঙ্কায়ও বিনিয়োগ করে। হাম্বানতোতা বন্দরসহ চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে অবকাঠামো খাতে একের পর এক উচ্চাভিলাষী প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে শ্রীলঙ্কা। অথচ এসব প্রকল্প থেকে আয় এসেছে সামান্যই। কিন্তু চীনের ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে অর্থনীতিতে নেমে এসেছে বিপর্যয়। বর্তমানে চীনের কাছে ভয়াবহ মাত্রায় ঋণী শ্রীলঙ্কা। শুধু অর্থনৈতিক নয়; চীন ও কোয়াড জোটের মধ্যকার কৌশলগত বৈরিতায় পড়ে শ্রীলঙ্কা। এখন শ্রীলঙ্কা থেকে কৌশলগত সুবিধা অর্জন করার এক অশুভ প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। তবে এটা অনস্বীকার্য, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকটই শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি বেশ জটিল করে ফেলেছে। বিশেষ করে গত কয়েক মাসে সেখানে অর্থনৈতিক সংকট যতটা ঘনীভূত হয়েছে, সরকারবিরোধী বিক্ষোভও ততটা বেড়েছে। সেখানে জরুরি অবস্থা জারি করলেও বিক্ষোভ তুঙ্গে। এরই পরিণতি মাহিন্দার পদত্যাগ এবং শ্রীলঙ্কায় ক্ষমতাসীনদের বাড়ি বাড়ি আগুন।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অভাব যেমন ভূমিকা পালন করেছে, তেমনি দেশটির ওপর কভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির প্রভাব পড়েছে। করোনার কারণে শ্রীলঙ্কার পর্যটননির্ভর অর্থনীতি বেশ ভালোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত। উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের কারণে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক রিজার্ভ কমে যায় ব্যাপকভাবে। তা ছাড়া কর ও ট্যাক্স কমানোর মনোরঞ্জনবাদী সিদ্ধান্তও আত্মঘাতী হিসেবে দেখা দেয়।
শ্রীলঙ্কার সংকটের পেছনে রাজনৈতিকভাবে মাহিন্দা রাজাপাকসের ভুল সিদ্ধান্ত কম দায়ী নয়। মাহিন্দা দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর যেভাবে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। বিরোধী দলগুলোও তার সিদ্ধান্তের কারণে আরও প্রতিশোধপরায়ণ হয়েছে। সেখানে রাজাপাকসে পরিবার যেভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছে, তাও অনেকে মেনে নিতে পারছে না। এভাবে জনগণ যেমন দ্বিধাবিভক্ত, তেমনি বিরোধী দলগুলোও রাজাপাকসে পরিবারের বিরুদ্ধে একাট্টা। পাকিস্তানে আমরা যেমন দেখেছি; ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য প্রায় সব বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নেমেছিল; শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতিও অনেকটা সে রকম।
শ্রীলঙ্কার চলমান বিক্ষোভ কতদিন চলবে, তা নির্ভর করছে সেখানকার বিরোধীরা কতদিন ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে, তার ওপর। শ্রীলঙ্কার এ বিক্ষোভ কতটা গণবিক্ষোভ কিংবা সেখানকার জনগণের কত অংশ এর সঙ্গে রয়েছে, তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। মনে রাখতে হবে, প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে অধিকাংশ ভোট পেয়েই নির্বাচিত হয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে পরিবারের জনপ্রিয়তা রয়েছে। জনগণের ম্যান্ডেট বোঝা সহজ নয়। আমরা দেখছি, ফিলিপাইনে আবারও ক্ষমতায় এসেছে মার্কোস পরিবার। সেখানকার নির্বাচনে সাবেক স্বৈরশাসক ফার্দিনান্দ মার্কোসের ছেলে ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। চলমান অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারলে অন্যান্য সমস্যার সমাধানও কঠিন নয়। সেখানকার অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখন বহির্বিশ্বের সহায়তা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সে সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না। কিংবা পাওয়া গেলেও তা পর্যাপ্ত নয়। আমরা বিস্ময়করভাবে লক্ষ্য করছি, ইউক্রেনে যেখানে যুদ্ধ চলছে, সেখানে দুই দফায় প্রায় ৫৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অথচ শ্রীলঙ্কায় পশ্চিমা বিশ্ব এগিয়ে আসছে না। শ্রীলঙ্কার এ সংকটে আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী, চীন, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একত্রে বসে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। শ্রীলঙ্কা নিয়ে বৈশ্বিক খেলা বন্ধ করে তার জনগণের পাশে দাঁড়ানো জরুরি। শ্রীলঙ্কার এমন সংকটে বিশ্বসম্প্রদায় নির্লিপ্ত থাকতে পারে না।
শ্রীলঙ্কার সমস্যা সমাধানে সেখানকার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দলগুলোরও আন্তরিকতা প্রয়োজন। বিরোধিতার স্বার্থে বিরোধিতা না করে সংকট সমাধানে জনগণের পাশে তাদেরও দাঁড়ানো উচিত। আমরা দেখছি, শ্রীলঙ্কায় নতুন সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। এখন নতুন সরকার ক্ষমতায় এলেও কি সংকটের রাতারাতি সমাধান হয়ে যাবে? বরং শ্রীলঙ্কা বর্তমানে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ যে অর্থনৈতিক সংকট পার করছে, তার সমাধানে সরকারের সঙ্গে বিরোধীরা বসুক। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক আন্তরিকতা এবং বৈশ্বিক সহায়তার মাধ্যমেই সমাধান খুঁজতে হবে।
ড. দেলোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োজিত
মন্তব্য করুন