অনেক দিন ধরে দেশে ভোজ্যতেলের বাজার অস্থিতিশীল। এরই মধ্যে কয়েকবার দাম বেড়েছে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি ভোজ্যতেল পরিশোধনকারীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে আট টাকা বৃদ্ধি করেছিল। ওই সময় এ নিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে চরম অসন্তোষ পরিলক্ষিত হয়। এরপর মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে পরিশোধনকারীরা আবারও প্রতি লিটারে ১২ টাকা দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করলে মুনাফাদারীরা মজুতের মাধ্যমে দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারায় লিপ্ত হয়। সর্বশেষ ৫ মে আবার তেলের দাম বাড়ানো হয় সর্বোচ্চ ৩৮ টাকা এবং পাম অয়েল ৪৪ টাকা। এখন এক কেজি সয়াবিন তেলের দাম ডাবল সেঞ্চুরি পর্যন্ত পৌঁছেছে। এ ক্ষেত্রে তেলের আমদানি ও পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে সরবরাহ কমে দেওয়ায় বাজার পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন অনেক পাইকারি ব্যবসায়ী। 

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ভোজ্যতেলের বাজারে রীতিমতো নৈরাজ্য চলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে বারবার এ দেশের ব্যবসায়ীরা বাজারে দাম বাড়াচ্ছে। বাস্তবে বিশ্ববাজারের সঙ্গে বাংলাদেশের বাজারদরের কোনো সম্পর্ক নেই। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করছে। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষ সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। তার মধ্যে রান্নার গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ ভোজ্যতেলের বাড়তি দাম তাদের আর্থিক চাপ আরও বাড়াচ্ছে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে আজকের এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় স্থিতিশীলতা ফেরাতে কঠোরভাবে বাজার নজরদারি বাড়ানোই সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। ইচ্ছামতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।

বিদেশ থেকে আমদানি করা বিপুল পরিমাণ সয়াবিন ও পাম অয়েলবাহী জাহাজ বাংলাদেশের জলসীমায় পৌঁছেছে। সেসব জাহাজ এখন চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান করছে। আবার গত বছর দেশের উদ্যোক্তাদের আমদানি করা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সয়াবিন ও পাম অয়েলের শুল্ক্কায়ন করেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলেও দেশে এখন সংকটের কারণে তেলের দাম বাড়ার কথা নয়। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজার কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এসবের কারণে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি সত্য হলেও আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে এর প্রভাব অন্তত আরও দুই মাস পর পড়বে। ফলে এ অজুহাতেও দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই। সুতরাং কৃত্রিমভাবে যে সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কয়েক দিন ধরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালাচ্ছে সরকারি সংস্থা ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তাদের অভিযানে ভোজ্যতেলের কোনো ঘাটতি না থাকলেও ডিলারদের কারসাজিতে বাজারে সয়াবিন তেলের 'কৃত্রিম সংকট' সৃষ্টি হয়েছে বলে প্রমাণ মিলেছে। অভিযানে কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে জরিমানা করা হচ্ছে।

কার্যত দেখা যায়, কয়েক দিন সংবাদমাধ্যমে অসাধু গুদামজাতকারী ব্যবসায়ী, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী অনৈতিক তথাকথিত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কিছু সংবাদ প্রকাশ করা হয়। তবে এসব সংবাদ প্রকাশের তীব্র জনমত তৈরি হলেও পণ্যমূল্যের বাজারে দাম তেমন একটা কমতে দেখা যাচ্ছে না। অনেকের ধারণা, এসব অসাধু ব্যবসায়ী অনৈতিকভাবে উপার্জিত অর্থের একটি অংশ সংশ্নিষ্ট অসাধু কর্মকর্তাদের দিকে ছুড়ে দিয়ে জনগণের পকেট কাটা, লোক ঠকানো এবং ফাটকাবাজি ব্যবসা চালিয়ে যেতে দেখা যায়। তা না হলে ভোজ্যতেল, চালসহ নানা ভোগ্যপণ্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের কারসাজিতে প্রশাসন নড়েচড়ে বসার মতো কোনো ঘটনা দেখা যায়নি। বিষয়টি অনেকেই স্বাভাবিকভাবে চলছে বলে মতপ্রকাশ করে বারবার আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে আবার ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত সামনে আনছেন। তবে চাল, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, রমজান-সংশ্নিষ্ট পণ্যসামগ্রী, কোরবানি-সংশ্নিষ্ট পণ্যসামগ্রীর দাম কৃত্রিমভাবে বাড়ানোর অপসংস্কৃতি দেশে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এর ফলে দুর্নীতি, অনিয়ম, সুবিধাবাদী, অসাধু উপায়ে অর্থ উপার্জনকারীরা দ্রুত দেশে কোটিপতির সংখ্যা বাড়িয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে সাধারণ, সীমিত আয়ের মানুষ অতিকষ্টে কোনোরকম জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে। যার কারণে প্রকৃত প্রস্তাবে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। অথচ সে হিসাব কোনো পরিসংখ্যানে যথাযথভাবে উঠে আসছে না। যার কারণে দেশের মানুষের গড় আয় বেড়েছে এবং ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে- এমন মন্তব্য করতে দেখা যায়। তবে গড় আয় বেড়েছে একশ্রেণির সরকারি চাকরিজীবী, চোরাকারবারি, অসাধু ব্যবসায়ী এবং অনৈতিকভাবে সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে অর্থ উপার্জনকারীদের। ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার ইতিহাসও তাদের চৌহদ্দিতে ঘুরপাক খাচ্ছে মাত্র। দেশটাকে অসংখ্য অসাধু ব্যবসায়ী সম্প্রদায় লুটেপুটে খেয়ে যাচ্ছে। যার কারণে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পরিবর্তে বাজারদর নিয়ন্ত্রণ সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ উপর্যুপরি অসাধু ব্যবসায়ীদের নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে সাধারণ জনগণের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ টিসিবির গাড়ি থেকে ন্যায্যমূল্যে পণ্য কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে ট্রাকে। মারামারির ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে। এ ঘটনা আমাদের জন্য মোটেই ভালো খবর নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনার মতো দীর্ঘ মহামারি এবং নানা বিধিনিষেধের কারণে স্বল্প আয়ের মানুষই বেশি বিপদে পড়েছেন, যাদের বেশিরভাগই কাজ হারিয়েছেন। ছোটখাটো অনেক ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা পথে বসেছেন। এর পাশাপাশি প্রতিদিন বেড়েই চলছে নিত্যপণ্যের দাম। এ অবস্থায় মানুষের অসহায়ত্বও বাড়ছে। সরকারের কাছ থেকে এই অসহায় মানুষের যে সহায়তা পাওয়ার কথা, তার খুব সামান্যই পেয়েছেন। প্রান্তিক ও সীমিত আয়ের মানুষ কঠিন অবস্থার মধ্যে আছেন। এর মধ্যে টিসিবির অবস্থা হয়েছে 'সাধ আছে, সাধ্য নেই'। যত মানুষ ট্রাক ও দোকানের সামনে ভিড় করছেন, তাদের সবাই পণ্য পাচ্ছেন না। এ ছাড়া গ্রাহকের তুলনায় পণ্য কম, আর যথাসময়ে ট্রাক নির্দিষ্ট স্থানে না আসায় নানা ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এ অবস্থায় টিসিবি ট্রাকগুলো নিয়ম মেনে যথাস্থানে চলে আসা জরুরি। আর সরকারের উচিত টিসিবির মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেওয়া, না হলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়তেই থাকবে।

সরবরাহ ঘাটতিজনিত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি একটি বৈশ্বিক প্রপঞ্চ। এ ধরনের সংকটে দাম কমবেশি সবখানেই বাড়ে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশে দামের সমন্বয়টা এমনভাবে করা হয়, যাতে বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর অভিঘাত যথাসম্ভব কম পড়ে। মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কোথাও বাজার বিকৃতি ঘটছে কিনা, বিপণন ব্যবস্থায় সমস্যা হচ্ছে কিনা, ক্ষুদ্র কোনো গোষ্ঠী সিন্ডিকেট করছে কিনা সবকিছু অনুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখা হয়। আইন অনুযায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রকৃত কারণে দাম বাড়লে সরকারি উদ্যোগে ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যাতে সর্বসাধারণের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। আমদানীকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক্ক কমানোর মতো উদ্যোগ নেওয়া হয়। সর্বোপরি সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাড়ানো হয় বাজার নজরদারি। বহুদূরে যেতে হবে না। প্রতিবেশী ভারতেও মানুষের ওপর দাম অভিঘাত প্রশমনে বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়। ওইসব দেশের নীতি ও অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। নয়তো নিত্যপণ্য মূল্যে বৃদ্ধির কারণে সরকারের সব উন্নয়নের কৃতিত্ব ব্যর্থ হয়ে যাবে।