
পৃথিবীতে ধর্ম এসেছে মানুষের জীবনবোধকে পরিচ্ছন্ন, নির্মল ও বিশুদ্ধ করার মহান ব্রত নিয়ে। সব ধর্মমতই মানবিকতা, প্রেম ও শান্তির কথা বলে। একটা পরিশীলিত জীবনাচার, সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা আর মহত্তম আদর্শের কথা বলে। জীবনকে সুশৃঙ্খল উপভোগের প্রকৃষ্ট উপকরণ আর সৃষ্টি ও স্রষ্টার মাঝে মিলনের সেতুবন্ধ হিসেবে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সংগীতকে বিবেচনা করা হয়। প্রকৃতির নির্মল সৌন্দর্য, ধর্মের অন্তর্নিহিত ভাব ও অধ্যাত্মবাদের মাহাত্ম্য অনুধাবন করতে সংগীতের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। পৃথিবীর সব ধর্ম ও দর্শনে তাই সংগীতের রয়েছে অপরিসীম গুরুত্ব। হিন্দু, ইহুদি, খ্রিষ্ট ও ইসলাম ধর্মের প্রাত্যহিক জীবনাচারে আমরা সংগীতের ঘনিষ্ঠ প্রয়োগ দেখতে পাই। পবিত্র ইসলামের নিত্যদিনের আমল হিসেবে পাঁচবার আজান ও নামাজে মনোমুগ্ধকর ও চিত্তাকর্ষক সুরের মূর্ছনা উপভোগ করি। কনফুসীয় ধর্মের মূল রসদ হচ্ছে তার সংগীত। এগুলো বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মীয় সংগীতের মতোই সামঞ্জস্যপূর্ণ। এভাবে প্রতিটি ধর্মের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক রীতিনীতিতে সংগীতের সংশ্নিষ্টতা এক অনিবার্য বাস্তবতা।
ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সংগীতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সামার, সুফি সংগীত, কাওয়ালি। এর বাইরে বাউল, মারফতি ছাড়াও অনেক ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সংগীতের প্রকার রয়েছে। আমরা প্রথমেই সামার বিষয়টি আলোচনা করতে চাই। সামা আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো শ্রবণ করা। পারিভাষিক অর্থে সামা বলতে ধর্মীয় সংগীত বা ভাব সংগীত বোঝায়। পবিত্র কোরআনে কবি ও কবিতার কথা উল্লেখ রয়েছে; মূলত কবিতার সঙ্গে সুর, তাল ও লয় যোগ করলেই তা সংগীতে পরিণত হয়। আর সেই সংগীতের মূর্ছনায় আন্দোলিত হয় জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষ; আর মানবজীবনে সংগীতের প্রভাব সুস্পষ্ট। এসব দিক বিবেচনায় খাজা মইনুদ্দিন চিশতি, ইমাম গাজ্জালি, শেখ সাদি শিরাজি, জালালুদ্দিন রুমিসহ বিশ্ববরেণ্য সুফিরা সামা তথা ধর্মীয় সংগীতকে পুরোপুরি বৈধ বলেছেন। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী, ধর্মতত্ত্ববিদ ও বুজুর্গ সুফি কবি শেখ সাদি শিরাজি সামার গুরুত্ব সম্বন্ধে বলেছেন, 'পুরো বিশ্ব
সংগীত, প্রেমমত্ততা ও সুরে পরিপূর্ণ। কিন্তু যে আসলে অন্ধ সে আয়নাতে আর কী দেখবে?'
প্রেম ও প্রজ্ঞার বাহক, অধ্যাত্মবাদের শ্রেষ্ঠতম দার্শনিক জালালুদ্দিন রুমি বলেন, 'যেথায় তুমি নিজেকে ভেঙে চুরমার করতে পার, সেখানে তুমি নৃত্য করো; তোমার কামপ্রসূত ক্ষত মুখ থেকে তুলার পট্টি যেন অপসারণ করতে পারো।'
বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ইমাম গাজ্জালি বলেছেন, 'বিজ্ঞ হোক আর অজ্ঞ হোক যারা সুফিদের সামা, অজ্দ বা সংগীতের প্রভাবজনিত হৃদয়ে সৃষ্ট আলোড়ন ও অনুপম অবস্থাকে অস্বীকার করে, তারা বস্তুত এখনও শিশু। তারা নিতান্ত নির্বোধ।'
বাংলাদেশে ইসলাম এসেছে সুফিদের মাধ্যমে। সুফিরা উদার, অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন। তারা ছিলেন নিঃস্বার্থ ও নির্লোভ চিত্তের। বাঙালির মন-মানসে সুফিদের অনুপম আদর্শ রেখাপাত করেছে। সে জন্য জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালি এক অসাম্প্রদায়িক জীবনাদর্শ লালন করে এবং একে অন্যের প্রতি সহনশীল থাকতে সচেষ্ট। সামা, বাউল, কাওয়ালিসহ যাবতীয় ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সংগীতকে তারা ভালোবাসে এবং হৃদয়ে ধারণ করে। এর পাশাপাশি বঙ্গীয় অঞ্চলে আগমনকারী আমাদের পূর্বসূরি সুফিদের আদর্শ ধারণ করলে বাংলাদেশের সর্বত্র সব ধর্মমতের মানুষের মাঝে সহাবস্থানের প্রেমময় পরিবেশ বিরাজমান থাকবে- এ কথা নির্দি্বধায় বলা যায়।
বাংলাদেশে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সংগীতের এক স্বর্গোদ্যান হলো চট্টগ্রামের মাইজভান্ডার দরবার শরিফ। এ দরবারে সুফিতাত্ত্বিক পরিবেশনা, বাউল আর কাওয়ালির সমন্বয়ে উপস্থাপিত সামা মাহফিল হয়ে ওঠে স্রষ্টাপ্রেমের এক মিলনমেলা। ভক্তিবাদের পরম নিদর্শনও পরিলক্ষিত হয় সেখানে। 'কাওয়ালি' এক প্রকার আধ্যাত্মিক প্রেমবিষয়ক ভক্তিমূলক গান। 'কওল' থেকে কাওয়ালি শব্দটির উৎপত্তি। কওলের আভিধানিক অর্থ বলা। কাওয়ালি সুফিদের গান। বহুকাল আগে সুফি-সাধকরা খোদার প্রেমে মশগুল হয়ে বিশেষ কোনো নামের জিকির করতেন। অর্থাৎ, একই শব্দ বা বাক্য পুনরাবৃত্তি করতেন। সুরের মাধ্যমে এই পুনরাবৃত্তি ঘটলে তাকে কাওয়ালি বলা হতো। অষ্টম শতাব্দীতে পারস্যের বিভিন্ন সুফি আস্তানায় এ ধরনের গানের আসর বসত। বর্তমানেও মাইজভান্ডার শরিফের বিখ্যাত শিল্পী নাসির কাওয়াল তার সাংস্কৃতিক পরিবেশনার দ্যুতি ছড়িয়ে চলেছেন। সংগীতের এসব মজলিসে এক ধরনের ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ আধ্যাত্মিক মিলনমেলার অনুপম পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে থাকে।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন: চেয়ারম্যান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিষয় : ইসলাম ও সমাজ মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন
মন্তব্য করুন