
শ্রীলঙ্কায় গণরোষে সরকারের পতন ঘটছে। একচ্ছত্র পুঞ্জীভূত ক্ষমতার চর্চা আর সীমাহীন দুর্নীতিতে দেশটির অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে যাওয়ায় জণগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। দেশটিতে জ্বালানি তেলের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সরকার দৈনন্দিন জীবনের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জোগান দিতে ব্যর্থ হচ্ছিল কয়েক মাস ধরে। বৈদেশিক ঋণের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে বলতে গেলে এক প্রকার দেউলিয়া হয়ে গেছে রাজাপাকসের সরকার। চীনা অর্থায়নে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের জেলা হামবানটোটায় নির্মাণ করা হয়েছে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর। ১৪০ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে করা এই বন্দর থেকে আসেনি কিছুই। অবশেষে সমুদ্রবন্দরটি তুলে দেওয়া হয়েছে চীনের একটি কোম্পানির কাছে। ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি আধুনিক বিমানবন্দর করেছে রাজাপাকসের সরকার। তা দেশটির অর্থনীতিতে কোনো কাজেই আসেনি।
শ্রীলঙ্কা একটি দ্বীপরাষ্ট্র। আশির দশকের শুরুতে দেশটি গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হয়। প্রেসিডেন্ট জয়াবর্ধনের আমলে তামিল জনগোষ্ঠী আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীও তামিল গেরিলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। এক সময়ে তাদের হাতে নিহত হন তামিল টাইগার নেতা প্রভাকরণ। শান্তি আলোচনায় তামিলদের সঙ্গে সমঝোতায় আসে শ্রীলঙ্কা সরকার।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে তামিল জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগ্রামের সময় সেনাপ্রধান ছিলেন। তাদের পরিবার শ্রীলঙ্কার দক্ষিণাঞ্চলের প্রভাবশালী পরিবার। গোটাবায়া সেনাপ্রধান হিসেবে তামিলদের বিদ্রোহ দমনে বড় ভূমিকা রাখেন। রাজাপাকসের পরিবার শ্রীলঙ্কার সিংহলি সম্প্রদায়ের ভেতর জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০০৪ সালে মাহিন্দা রাজাপাকসে হয়ে যান প্রধানমন্ত্রী। তার পরের বছর ২০০৫ সালে হন প্রেসিডেন্ট। টানা ১০ বছর প্রেসিডেন্ট থাকেন তিনি। ২০১৯ সালে ছোট ভাই সাবেক সেনাপ্রধান গোটাবায়া প্রেসিডেন্ট হলে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন মাহিন্দা রাজাপাকসে।
১৯৮৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত টানা ২৫ বছর তামিল জনগোষ্ঠীসৃষ্ট গৃহযুদ্ধ থেকে বের হয়ে শ্রীলঙ্কার জণগণ একটি স্থিতিশীল সমাজ ও অর্থনীতি গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিল, তা বিগত ১৩ বছরে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। এর মূল কারণ সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের নীতিহীনতা। রাজাপাকসের পরিবার এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল, যেখানে সংসদ সদস্যদের জনগণের কাছে কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না। পরিবারতন্ত্রের তোষামোদি ছিল, যার পেছনে ছিল ঘুষ ও দুর্নীতি। রাজাপাকসের পরিবারের সদস্য বাসিল রাজাপাকসে ছিলেন দেশটির অর্থমন্ত্রী। তাকে ডাকা হতো মি. টেন পার্সেন্ট বলে।
শ্রীলঙ্কায় ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে, যা থেকে কোনো লাভ আসেনি। কিন্তু কমিশন এসেছে রাজাপাকসের পরিবার ও দলের এমপিদের। দুবাইয়ের আদলে ৬৬৫ একর জমিতে একটি বিলাসবহুল শহর গড়ে তোলা হয়েছে, যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনে কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। কমিশন এসেছে ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের পকেটে, তারপর সরকারি আমলাদের মধ্যে ছড়িয়েছে সেটি। পরিস্থিতি হয়েছে নচিকেতা চক্রবর্তীর উল্টো রাজা গানের মতো- 'সে দেশে ধার করে ভাই শোধে রাজা ধারের টাকা, মরে ভূত হলো মানুষ লোক দেখানো বদ্যি ডাকা'। বিগত কয়েক মাসে পণ্য আমদানি করতে পারছিল না রাজাপাকসের সরকার। ডলার নেই এলসি করার। করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এমনিতেই বিশ্ব-অর্থনীতি টালমাটাল। সুশাসনের অভাবে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসের সরকারের প্রথম স্বীকার।
অনেকেই আশঙ্কা করছেন, বড় বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া বাংলাদেশের পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার মতো হয় কিনা। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির বড় প্রকল্পগুলো যেমন চীনের অর্থায়নে হয়েছে, বাংলাদেশেও তাই। রাষ্ট্রায়ত্ত চুক্তিগুলো নিয়ে আমাদের দেশে জণগণের জানার অধিকার খুবই কম। আমরাও জানি না; যেমন জানত না শ্রীলঙ্কার জনগণ।
বস্তুত সুশাসনের অভাব আজকের নয়; বিগত ৫০ বছরের। হু হু করে বাড়ছে মাথাপিছু আয়; সেই সঙ্গে দারিদ্র্য আর ধনী-গরিবের বৈষম্য। সুশাসনের অভাবে সৃষ্ট বৈষম্য সমাজ ও অর্থনীতিকে অস্থির করে তোলে স্বাভাবিকভাবে। যারা ক্ষমতায় আছে তারা তো বটেই, যারা ক্ষমতার দাবিদার তাদের কারও প্রতিই জনগণের আস্থা কম। জনগণ হয়ে পড়েছে রাজনীতিবিমুখ।
আমরা কখনোই চাইব না- আমাদের পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার মতো হোক। আমাদের কৃষিতে সাফল্য আছে। আছে মানবসম্পদেও সাফল্য। আমাদের জনগণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল নয়। তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিক, জমিতে ফসল উৎপাদন করা কৃষক, বিদেশে গায়ে-গতরে খেটে রোজগার করা প্রবাসী বাংলাদেশকে যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম করে তুলেছে। কিন্তু একটা বিশৃঙ্খলা যে সৃষ্টি হতে পারে- তার আশঙ্কা দূর করে দেওয়া যায় না। শ্রীলঙ্কায় দেখা দেওয়া গণরোষ থেকে শিক্ষা নিয়ে এখনই প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
যদি ক্ষমতাসীন দল ও ক্ষমতার দাবিদার রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র, নাগরিক সমাজ সবাই মিলে গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা ও বৈষম্য রোধে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণে ব্যর্থ হয়, তাহলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে তার ফলাফল তৃতীয় কোনো শক্তির কাছে চলে যেতে পারে। তাতে শুধুই লাভবান হবে অন্ধকারের শক্তি।
রুস্তম আলী খোকন: সাবেক ছাত্রনেতা
মন্তব্য করুন