
কোনো দল নির্বাচনে আসবে কিনা, তা আমাদের দেখার বিষয় নয়- এমন কথা আওয়ামী লীগের নেতারা বলে আসছিলেন। গত ৭ মে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় তা নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, 'বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে হবে। তাদের নির্বাচনে আনার জন্য প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগই নেওয়া হবে।' (সমকাল :৮ মে ২০২২)। এটি সঠিক উপলব্ধি।
ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে যেমন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না; তেমনি বিএনপিকে বাদ দিয়েও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অংশগ্রহণই শেষ কথা নয়। অংশগ্রহণমূলক ও অর্থবহ নির্বাচনের জন্য ছোট-বড় সব দলকে নির্বাচনে আনতে হবে এবং জনগণের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পর্কে আশাবাদ ফিরিয়ে আনতে হবে। এই দায়িত্ব কার এবং কতটুকু?
অংশগ্রহণমূলক অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন, সরকার, বিরোধী দল ও জনগণ- সব অংশীজনেরই ভূমিকা ও দায় রয়েছে। তবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মূল ভূমিকায় থাকে নির্বাচন কমিশন। তাই ভালো নির্বাচনের জন্য প্রশংসা এবং খারাপ নির্বাচনের জন্য সমালোচনা দুই-ই কমিশনের সমানভাবে প্রাপ্য।
নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচনের তফসিল থেকে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত সব আয়োজন সম্পন্ন করা। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন চলাকালে সংশ্নিষ্ট পুলিশ ও প্রশাসন তার ওপর ন্যস্ত থাকবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীও মোতায়েন করতে পারবে। তবে যতখানি ক্ষমতা কাগজে আছে, ততখানি চর্চায় নেই। আসল সত্য যে, নির্বাচন কমিশন সেই মর্যাদাপূর্ণ ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়নি। এর আগে যতটুকু ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল; বিগত কমিশন তা তলানিতে নিয়ে গেছে। ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক নূরুল হুদা কমিশনের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিলেন এবং রাষ্ট্রপতিকে তা অবহিত করেছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান আউয়াল কমিশন প্রতিষ্ঠানটির নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করবে; না পূর্বসূরি নূরুল হুদা কমিশনের পথে হাঁটবে?
রাজনীতিতে এখন পেশি ও কালো টাকার দৌরাত্ম্য, যা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে; কলুষিত করছে। ভোট কেনাবেচা সেকেলে ব্যাপার। তারপরও হয়। পেশির জোরে বা টাকার খেলায় বুথ দখল হয়। দিনের ভোট রাতেও হয়। এসব নিয়ন্ত্রণ করতে প্রয়োজন মেরুদণ্ড শক্ত নির্বাচন কমিশন, যারা অন্যায় প্রস্তাবের কাছে মাথা নত করবে না; সরকারের মন জুগিয়ে চলবে না।
বিতর্ক হচ্ছে ইভিএম নিয়েও। সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের যে একাধিক বৈঠক হয়েছে, সেখানেও ইভিএমের নেতিবাচক দিক প্রাধান্য পেয়েছে। ইভিএমেও যে একজনের ভোট অন্যজন দিতে পারে- তারও প্রমাণ রয়েছে। দেখা গেছে, আঙুলের ছাপ দিয়ে বুথে পৌঁছার আগেও ভোট হয়ে যায়। গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমিও এমন ঘটনার শিকার। যথানিয়মে আঙুলের ছাপ দিয়ে বুথে গিয়ে দেখলাম, এক ব্যক্তি সেখানে বসে আছে। আমি তাকে বের হতে বললাম, তবে সে বের হওয়ার আগে ব্যালটে টিপ দিয়ে গেল। চিৎকার করলাম, সবাই ছুটে এলো। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে।
এ ছাড়া ইভিএমে অনেকের আঙুলের ছাপ মেলে না। ভোট বিলম্বিত হয়। সবচেয়ে বড় ত্রুটি, ইভিএমে ভোটার ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) নেই। এটি না থাকায় কেউ ভোট দেওয়ার পর যাচাই করে দেখতে পারছে না, সে কাকে ভোট দিয়েছে। কোনো বিতর্ক দেখা দিলেও যাচাইয়ের সুযোগ নেই। নির্বাচন কমিশন ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে কারিগরি কমিটির চেয়ারম্যান করেছিল। তিনি ভিভিপিএটি সংযোজনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, ভারতে ভিভিপিএটি সংযোজনের পরও বিতর্ক রয়েছে। কারণ ইভিএমে যত সহজে কারসাজি করা যায়, তত সহজে ব্যালট পেপারে করা যায় না।
সব বিতর্ক ছাড়িয়ে বড় বিতর্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকার ব্যবস্থাপনা। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে- সরকার চাইলে ভালো নির্বাচন হয়। সরকার না চাইলে তা হয় না। ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের চাওয়াই অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
পুলিশ ও প্রশাসন গণপ্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। বাস্তবে তারা ক্ষমতাসীনদের অনুগত সংস্থায় পরিণত হয়। পুলিশ-প্রশাসন বিএনপির শাসনামলে বিএনপির অনুগত ছিল; জাতীয় পার্টির শাসনামলে জাতীয় পার্টির অনুগত ছিল; এখন আওয়ামী লীগের অনুগত। অনেক সময় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও মহলের স্বার্থেও ব্যবহূত হয়। অনেক সময় তারা আগ বাড়িয়ে বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন করে; সভাসমাবেশ ভেঙে দেয়। তাদের কারণেও গণতান্ত্রিক আবহ ক্ষুণ্ণ হয়; সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যায়। এ কারণে এরশাদের শাসনামলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উঠেছিল এবং ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার শাসনামলে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা একই দাবি তুলেছিল এবং আন্দোলনের মুখে এটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সে অনুযায়ী ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন হয়েছিল। এসব নির্বাচন ছিল তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য।
এর নেতিবাচক দিকও ছিল। বিচার বিভাগ ঘিরেও রাজনীতি শুরু হয়েছিল। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছিল। এর পেছনে তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার অভিপ্রায় কাজ করেছিল। এর পর রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছিল। এর ফলে ১/১১-এর ঘটনার মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীও রাজনীতিতে জড়িয়েছিল। অবশেষে আদালতের রায়ের আলোকে এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দলীয় সরকারের বিধানের পুনঃপ্রত্যাবর্তন ঘটেছে। ২০১৪ ও ১৮ সালের নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনেই হয়েছে।
এখন নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিপরীত অবস্থানে। সরকার বলছে- সংবিধানসম্মতভাবেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। বিএনপির কথা- এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। ২০১৪ ও ১৮ সালের বিতর্কিত, ভোটারবিহীন নির্বাচনই তার প্রমাণ। এই বিতর্কের সমাধান কী?
এখন আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নিয়ে আগামী নির্বাচন করতে চাইছে। ২০১৮ সালে ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে শরিক হয়ে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। এবার বিএনপি বলছে, আর নয়; এই সরকারের অধীনে নির্বাচন করবে না। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- তাহলে বিএনপি কী করবে? এর আগে তারা আন্তর্জাতিক মুরুব্বিদের কাছে ধরনা দিয়েছে। কাজ হয়নি। এখন আর প্রকাশ্যে এ ধরনের সালিশ-সালিশ করছে না। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বারবার বলেছেন, আন্দোলনের মাধ্যমে তারা দলনিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করে ছাড়বেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপির আর দর কষাকষির সুযোগ নেই। সরকার এক চুলও ছাড় দেবে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি বিএনপিকে নির্বাচনে আনার কৌশলের কথা বলেছে। এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বিএনপিকে নির্বাচনে আনার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চেয়েছেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সরকারও যেনতেনভাবে নির্বাচন করতে চাইছে না। বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে চাইছে না। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমঝোতার বিকল্প নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচনী বিতর্কের সমাধান হবে কোথায়- আলোচনার টেবিলে, বিদেশের দূতিয়ালিতে, না আন্দোলনের রাজপথে?
উল্লেখ্য, রাজনৈতিক অঙ্গনে দলীয় সরকার ও দলনিরপেক্ষ সরকারের বাইরেও তৃতীয় একটি মত রয়েছে। তা হলো- জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, আ স ম আবদুর রবসহ অনেকেই প্রস্তাব করছেন। এটি করতে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নেই।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে স্বরাষ্ট্রসহ একাধিক মন্ত্রণালয় গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। অনুরূপভাবে জাতীয় বা সর্বদলীয় সরকার গঠনের সুযোগ রয়েছে। তবে এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। কোন সরকারের অধীনে, কীভাবে নির্বাচন হবে- এ ব্যাপারে রাজনৈতিক ঐকমত্যের বিকল্প নেই। তবে বিদেশের দূতিয়ালিতে নয়; দেশের মাটিতে সরকার ও বিরোধীপক্ষকে নিজেদের গরজে, গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখতে ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে; অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে- সেটিই আজ প্রত্যাশিত।
আবু সাঈদ খান: লেখক ও সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
মন্তব্য করুন