গত ১০ এপ্রিল সমকালে প্রকাশিত মহেশখালী ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল সম্পর্কিত 'তরল গ্যাসে গরল হিসাব' শীর্ষক যে খবর প্রকাশিত হয়েছিল, তা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হয়ে থাকবে। এই টার্মিনাল ঘিরে এলএনজি আমদানির নামে দেশের অর্থ বিদেশে পাঠানোর যে নজিরবিহীন চিত্র প্রকাশ পেয়েছে, তা যে কাউকে হতবাক করবে।

খোদ টার্মিনালটির গোড়াতেই গলদ ছিল। আমরা জানি, অব্যাহত চাহিদা বৃদ্ধি ও সরবরাহের সীমাবদ্ধতা গ্যাস সংকট ডেকে আনে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নিয়েছিল। ২০১৭ সালে প্রথম ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল তথা এলএনজি রি-গ্যাসিফিকেশন প্লান্টটির নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। বিনা দরপত্রে বিওওটি বেসিসে এ কাজ দেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিদেশি কোম্পানি 'এক্সিলারেট এনার্জি'কে।

সমকালের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়ার অঙ্গরাজ্যের ডেলাওয়ার ডিভিশন অব করপোরেশন থেকে এক্সিলারেট এনার্জি বাংলাদেশ, এলএলসি এবং এক্সিলারেট এনার্জি বাংলাদেশ হোল্ডিংস, এলএলসি নামের এই দুটি কোম্পানি সেখানকার এক এজেন্ট কোম্পানির সহায়তায় নিবন্ধন পায়। এ দুটি কোম্পানির মাধ্যমে ১৮% সুদে বিনিয়োগ এনে এক্সিলারেট এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেড (ইইবিএল) গঠিত হয় এবং বাংলাদেশে নিবন্ধিত হয়। ইইবিএল ওই প্রকল্পে অর্থায়ন নিশ্চিত করে। অবশ্য এমন সব প্রক্রিয়ায় কোম্পানি গঠন করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের এই ট্রাস্ট কোম্পানি বিশেষভাবে পরিচিত।

খবরে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, প্রকল্পের 'স্থায়ী অবকাঠামোসংশ্নিষ্ট পণ্য' আমদানির জন্য ইইবিএল ফ্রান্সভিত্তিক 'জিওসান' কোম্পানিকে ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে কয়েক দফায় অগ্রিম ২,৬৪,৬৯,৯৫০ ডলার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠায়। কিন্তু তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি প্রদানে আপত্তি ছিল। ধারণা করা যায়, বিভিন্ন চাপের মুখে বাংলাদেশ ব্যাংক সে আপত্তি থেকে সরে আসে এবং শর্তসাপেক্ষে অনাপত্তি দেয়। শর্তটি হলো, অর্থ পাঠানোর ১২০ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ অর্থের কাস্টমস সার্টিফায়েড বিল অব এন্ট্রি জমা দিতে হবে। কোনো কারণে পণ্য আনতে না পারলে অর্থ ফেরত এনে রিপোর্ট করার বিধান মানতে হবে। ১২০ দিনের মধ্যে তো নয়ই, দীর্ঘ চার বছরেও ইইবিএল ওই শর্ত প্রতিপালন করেনি।

পরিশেষে গত ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক ইইবিএলের বিরুদ্ধে কেন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, জানতে চেয়ে শোকজ নোটিশ দেয়। গত ২০ ও ৩০ জানুয়ারি ইইবিএল দুই দফায় নোঠিশের জবাব দেয়। তাতে বলা হয়, জিওসানকে অগ্রিম অর্থ পাঠানো হয়েছিল 'মাইলস্টোন পেমেন্ট (লাম্পসাম)' হিসেবে। এ উপায়ে পাঠানো অর্থে পণ্য, সেবা বা পণ্য ও সেবা- উভয় ক্ষেত্রে মূল্য পরিশোধ করা যায়। ফলে ১,৪৫,৩১,৪৬৫ ডলারের পণ্য আমদানির বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা হয়েছে। বাকি অংশ বিদেশে খরচ হয়েছে যন্ত্রপাতি সংযোজন, পরামর্শ ফিসহ সেবা খাতে।

ইইবিএলের ওই বক্তব্য গ্রহণযোগ্য কিনা, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনাধীন থাকে। ইতোমধ্যে ইইবিএলের পক্ষ থেকে বিগত ১৩ জানুয়ারি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ, আরপিজিসিএল এবং পেট্রোবাংলাকে প্রদত্ত চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের উত্থাপিত আপত্তি দ্রুত নিষ্পত্তির অনুরোধ জানানো হয়।

ইইবিএলের অনুরোধে সাড়া দিয়ে উত্থাপিত আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ বাংলাদেশ ব্যাংককে বিগত ২৬ জানুয়ারি এক পত্র দেয়। ধারণা করা যায়, তারই ধারাবাহিকতায় গত ৭ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক, ইইবিএল এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় ইইবিএলের ফেরত না আনা অর্থেরও বিল অব এন্ট্রি দেখানোর সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে ইইবিএলের বিরুদ্ধে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাচারের এই অভিযোগ হয়তো আর সামনে আসবে না। তার পরিবর্তে তাদের রি-গ্যাসিফিকেশন ক্ষমতা দৈনিক ৫০০ থেকে ৬৬০ মিলিয়ন ঘনফুট বৃদ্ধি করার প্রস্তাব গৃহীত হবে। বলা বাহুল্য, সে ব্যয়ও ভোক্তার গ্যাসের মূল্যহারে সমন্বয় হবে।

অনাপত্তির শর্তমতে, ১২০ দিনের মধ্যে জিওসানকে পাঠানো সম্পূর্ণ অর্থের কাস্টমস সার্টিফায়েড বিল অব এন্ট্রি জমা দিতে হবে। অথচ তা জমা হলো না। শোকজ নোটিশের জবাবে ইইবিএল বলেছে, শুধু পণ্যের মূল্য নয়, সেবার মূল্য পরিশোধেও জিওসানকে পাঠানো অর্থের আংশিক ব্যয় হয়েছে। তাই ওই পাঠানো সম্পূর্ণ অর্থের কাস্টমস সার্টিফায়েড বিল অব এন্ট্রি জমা দেওয়া ইইবিএলের পক্ষ সম্ভব হয়নি।


সেবার মূল্য পরিশোধে পৃথকভাবে অর্থ পাঠানোর সুযোগ রয়েছে। এক্সিলারেট এনার্জির মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজ করা এমন এক বিদেশি কোম্পানির তা জানা থাকারই কথা। পণ্য কেনার জন্য বিদেশে অর্থ পাঠানোর ব্যাপারে যে প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইইবিএল অনাপত্তি নিয়েছে, অনুরূপভাবে সেবা কেনার জন্য অনাপত্তি নেওয়া ছাড়া কোনো অজুহাতে শর্ত লঙ্ঘন করে ওই পাঠানো অর্থের অংশ বিশেষ দ্বারা কোনো সেবার ক্রয়মূল্য পরিশোধ যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য নয়। তাই পণ্য আমদানির জন্য প্রাপ্ত অনাপত্তির শর্তাদিবহির্ভূত কোনো ব্যয় রি-গ্যাসিফিকেশন চার্জে সমন্বয়ে ক্যাবের (কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) আপত্তি রয়েছে।

২০২১ সালে এলএনজি রি-গ্যাসিফিকেশন চার্জ হার ছিল ১ দশমিক ২৭ টাকা। গণশুনানিতে বিইআরসির কারিগরি কমিটি (টিসি) প্রস্তাব করে ২ দশমিক ১৭ টাকা। আবার পেট্রোবাংলার এলএনজি অপারেশনাল চার্জ হার তখন ছিল শূন্য দশমিক ১৬ টাকা। গণশুনানিতে টিসির প্রস্তাব শূন্য দশমিক ২৯ টাকা। ক্যাবের আপত্তি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত উভয়ের ক্ষেত্রে বিদ্যমান চার্জহার বলবৎ রাখার প্রস্তাব করেছে ক্যাব।

সমকালের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইইবিএলের বিনিয়োগের পুরোটাই এসেছে ঋণ হিসেবে। এর মধ্যে শেয়ারহোল্ডারদের ঋণের নামে ১৮ শতাংশ সুদে আনা হয়েছে ৪ কোটি ৮৯ লাখ ৬২ হাজার ৪৭৮ ডলার। এই ঋণ সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সেই ডেলাওয়ারে নিবন্ধিত এক্সিলারেট এনার্জি বাংলাদেশ, এলএলসি এবং এক্সিলারেট এনার্জি বাংলাদেশ হোল্ডিংস, এলএলসি। বিশ্বের কোথায় এত উচ্চ সুদে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের নজির রয়েছে? শুধু ওই পরিমাণ সুদই ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের মূল্যহারে সমন্বয় হবে না, সমন্বয় হবে অগ্রিম কর, করপোরেট কর, পেট্রোবাংলার চার্জ, এলএনজি বাবদ আমদানি ও ভোক্তা পর্যায়ে ভ্যাট। তাই ওই ঋণের সুদ অন্যান্য ক্ষেত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে ৭ শতাংশ বেশি গ্যাসের মূল্যহারে সমন্বয় না করার জন্য ক্যাব প্রস্তাব করেছে।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, নিজস্ব সক্ষমতায় দেশের জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধান ও উৎপাদন করে নূ্যনতম ব্যয়ে কেবল নিজস্ব চাহিদা মেটানোর আকাঙ্ক্ষায় গ্যাস ও কয়লা রপ্তানি প্রতিরোধে দেশের মানুষ রাস্তায় নামে, জীবনও দেয়। অথচ সেই জন-আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষা করে নিজস্ব সক্ষমতায়, নিজস্ব জ্বালানি উন্নয়নের অভিমুখ পরিহার করে দেশকে জ্বালানি আমদানি বাজারে পরিণত করার রহস্য কী? কেন বিইআরসি আইন লঙ্ঘন করে জ্বালানি তেলের মূল্য জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ নির্ধারণ করে এবং বিইআরসি আইন বদলাতে চায়, তার কারণও জনসাধারণ জানতে চায়।

অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম: জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ