হঠাৎ ডলারের দাম ১০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এক দিনের ব্যবধানে খোলাবাজারে তা ৯৬ থেকে ১০২ টাকায় উঠে গেছে। আন্তঃব্যাংক ডলার লেনদেনের হার ৮৭ দশমিক ৫ টাকা; তার সঙ্গে ১০ পয়সা যোগ করে আমদানি দায় পরিশোধের জন্য আমদানিকারকদের কাছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ৮৭ দশমিক ৬ টাকায় ডলার বিক্রয় করার কথা থাকলেও তারা তা অনেক বেশি দামে বিক্রয় করেছে। ঘোষিত হারের বেশি দামে কী করে তারা ডলার বিক্রয় করে? পক্ষান্তরে তারা রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে ডলার ক্রয় করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত হারে; ৮৬ দশমিক ৬ টাকায়। মাত্র দুই দিন আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তঃব্যাংক ডলার লেনদেনের হার শূন্য দশমিক ৮০ টাকা বাড়িয়ে ৮৭ দশমিক ৫ টাকা করেছে। দেশে এ দুই দিনে এমন কিছু ঘটেনি বা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বড় কোনো রদবদল হয়নি যে, দুই দিনের ব্যবধানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ডলারের দাম প্রায় ১০ শতাংশ বাড়িয়ে দেবে। ডালমে কুছ কালা হ্যায়- এমন সন্দেহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকও করছে। একটা তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। দেখা যাক তারা কী খবর বের করে আনে!
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের সঙ্গে খোলাবাজারের হারের একটা পার্থক্য সবসময় থাকে। বেশিরভাগ সময়ে খোলাবাজারের বিক্রয়মূল্য বেশি থাকে। মাঝেমধ্যে উল্টো চিত্রও দেখা যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে খোলাবাজারে বেশি থাকাটা স্বাভাবিক। তাই বলে এত বেশি? খোলাবাজারে যারা ডলার কেনাবেচা করে তারা নির্দিষ্ট নিয়মকানুন মানার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে অনুমোদনপ্রাপ্ত। খোলাবাজার থেকে সাধারণত ডলার কেনে বিদেশ ভ্রমণকারীরা। দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের মধ্যে এর অংশ নিতান্তই কম। খোলাবাজারে ডলার কেনাবেচার অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকের বিরুদ্ধে হুন্ডি চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ বেশ পুরোনো। বিদেশে টাকা পাচারকারীরা ডলারের দাম হঠাৎ বাড়িয়ে দেয়নি তো?
অভ্যন্তরীণ বাজারে কারসাজির কারণে ডলারের দাম হঠাৎ এতটা বেড়ে গেছে কিনা, তা তদন্তসাপেক্ষ। বিশ্বব্যাপী ডলার শক্তিশালী হওয়ার প্রধান কারণ ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের ফলে জ্বালানি ও ভোজ্যতেল, খাদ্যশস্য, বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহূত ধাতু এবং রাসায়নিক সারের দাম বেড়ে যায়। রাশিয়ার তেল এবং গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল থাকায় এতে সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক চাপে পড়েছে ইউরোপ; খাদ্যশস্যের কারণে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার অনেক দেশ। রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস আমদানি বন্ধ করে নিজের অভ্যন্তরীণ এবং ইউরোপের গ্যাসের চাহিদা মেটাতে আমেরিকা তার তেলের রিজার্ভে হাত দিয়েছে। কৌশলগত কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল ও গ্যাসের অধিকারী আমেরিকা এতকাল নিজেদের ভান্ডার থেকে না তুলে তা বিদেশ থেকে আমদানি করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি মূল্য প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়ে যায়। এই সুযোগে আমেরিকা নিজের জ্বালানি উত্তোলন করে বেশি দামে তা ইউরোপের দেশে দেশে বিক্রয় করা শুরু করেছে। আগামীতে আরও বেশি করবে। বেশি জ্বালানি বিক্রি করে আমেরিকা আরও বেশি ডলার নিজের ঘরে নিয়ে আসছে; বিশ্ববাজারে ডলারের চাহিদা বাড়ছে; অন্যান্য মুদ্রার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে।


অন্যদিকে ইউরোপ ও আমেরিকায় চলছে ব্যাপক মুদ্রাস্ম্ফীতি। চীনে করোনাভাইরাসের প্রভাবে লকডাউন, ভারতে খরার কারণে গম উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত, ব্রাজিলে সয়াবিনের ফলন কম, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গম, জ্বালানি এবং ভোজ্যতেলের সরবরাহ ঘাটতি- এই কয়েকটি বড় কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতা চলছে। ইউরোপ, আমেরিকার মুদ্রাস্ম্ফীতি সাধারণত ২-৩ শতাংশের মধ্যে থাকে। এখন আমেরিকার মুদ্রাস্ম্ফীতি বিগত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে, ৮ দশমিক ৩ শতাংশ; যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপে তা ৭ শতাংশ। বছর শেষের দিকে যুক্তরাজ্যে মুদ্রাস্ম্ফীতি বেড়ে ১০ শতাংশ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছে সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শুধু মুদ্রাস্ম্ফীতিই নয়; যুক্তরাজ্যে বছরের প্রথম তিন মাসের জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ১ শতাংশ; যুক্তরাষ্ট্রে ঋণাত্মক ১ দশমিক ৪ শতাংশ; ইউরোপে বেড়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। ইউরোপ ও আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। খাদ্য সংকটে পড়তে যাচ্ছে বহু দেশ।
এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১ শতাংশ করেছে। ২০০৭-০৮ সালের আর্থিক মন্দার সময় সুদের হার কমিয়ে শূন্যের কাছাকাছি যে নেওয়া হয়েছিল, সেখান থেকে আর বাড়ানোর সুযোগ আমেরিকা এবং ইউরোপের হয়নি। মুদ্রাস্ম্ফীতি ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় এখন তা বাড়ানোর সময়। আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান জেরেমি পাওয়েল বলেছেন, মুদ্রাস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত সুদের হার বাড়ানো হতেই থাকবে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতি এবং মুদ্রা বিশ্নেষকরা মনে করছেন, সুদের হার বাড়তে বাড়তে তা ২-৩ শতাংশে গিয়ে ঠেকবে। একদিকে সুদের হার বৃদ্ধি, অন্যদিকে বাজারে বন্ডের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমেরিকার বাজারে বিনিয়োগ বেশি লাভজনক হয়ে উঠছে। ফলে সারা দুনিয়া থেকে ডলার আমেরিকামুখী হতে থাকবে। আমাদের বাজারে ডলারের দাম বাড়তেই থাকবে। আন্তর্জাতিক বাজারে শিগগিরই ডলারের দাম কমে আসার কোনো লক্ষণ এখন নেই।
ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার সবচেয়ে ক্ষতিকর উপসর্গ হচ্ছে মুদ্রাস্ম্ফীতি। আন্তর্জাতিক ব্যাজারের ওপর আমরা প্রধানত জ্বালানি ও ভোজ্যতেলের কারণে নির্ভরশীল। জ্বালানি তেলের দাম না বাড়িয়ে সবচেয়ে বড় চাপটা নিচ্ছে সরকার। ঈদের পর তেল নিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী যে তেলেসমাতি দেখিয়েছে, তা দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করে সবার আস্থা কুড়িয়েছে সরকার। এই দক্ষতা নিয়ে সতর্ক অবস্থায় থেকে ব্যবসায়িক সিন্ডেকেটগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে আমাদের মুদ্রাস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
বিশ্ববাজারে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়াকে শুধু দুর্ভোগ হিসেবে না দেখে একে সুযোগ হিসেবে দেখারও অবকাশ রয়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমে যাওয়ায় লাভবান হচ্ছে পোশাকশিল্প এবং প্রবাসীদের পরিবার-পরিজন। আমাদের বাজারে ডলারের দাম বৃদ্ধির আরেক উপকার হচ্ছে, অপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া; চাহিদা কমে যাওয়া। চলতি অর্থবছরে ৮ লাখের বেশি মানুষ বিদেশে গেছেন কাজ নিয়ে; রপ্তানি বেড়েছে ৩৫ শতাংশের বেশি। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমেরিকার নাগরিকদের কাছে পণ্যের দাম কমে আসছে। তাতে আমাদের পাঠানো পোশাকের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরও বেশি রপ্তানি বৃদ্ধি এবং বিদেশে মানুষ পাঠানো- দুটিরই যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সরকার আরও বেশি উদ্যোগী হলে বেশি বেশি রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের ব্যবস্থা করে বিশ্ববাজারে ডলারের দাম বৃদ্ধির ওপর ভর করে আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের সিঁড়িতে আরেক ধাপ এগিয়ে যেতে পারি।
সাব্বির আহমেদ: চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট