
শিক্ষাক্ষেত্রে উপর্যুক্ত প্রশ্নটি নতুন। আগে এ ধরনের প্রশ্ন কেন করতেন না; এখনও যে খুব একটা করেন, তা না। সব দেশে সব সময় মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়ার জন্য অল্প কিছু বিশেষ প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়, যেখানে কেবল একাডেমিক অর্থে খুব মেধাবী বা সমাজের উচ্চ কিংবা উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার সুযোগ পায়। ইটন বা হ্যারোর মতে, এ ধরনের বহু প্রতিষ্ঠানের নাম অনেকেই জানেন। আমাদের দেশেও মানসম্মত শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে মডেল স্কুল, ক্যাডেট কলেজ বা বিত্তশালী পরিবারগুলোর সন্তানদের জন্য কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের ভর্তি করানোর জন্য অভিভাবকদের মধ্যে যে তীব্র ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা হয়, তাতে স্কুলগুলোর মধ্যে সমতাহীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং বোঝা যায়, অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও শিক্ষার তথাকথিত 'মান'-এর সঙ্গে সমতার কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষ মান নিয়ে যতটা ভাবে, সমতা নিয়ে ততটা নয়।
সাধারণভাবে যাকে এতদিন 'মানসম্পন্ন শিক্ষা' বলা হয়েছে এবং টেকসই উন্নয়নে যাকে 'গুণগত শিক্ষা' বলা হচ্ছে, এ দুটো বিষয় এক নয়। মানসম্পন্ন শিক্ষা হচ্ছে কেবল একাডেমিক অর্থে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা। আর এখন যাকে 'গুণগত শিক্ষা' বলা হচ্ছে, সেটাতে একাডেমিক জ্ঞান কেবল একটা অংশ মাত্র। এর সঙ্গে আরও যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত করা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে আবেগীয় ও মনোপেশিজ দক্ষতা। জ্ঞানের ক্ষেত্রে আগে যেমন হতো, শিক্ষকরা দান করতেন আর শিক্ষার্থীদের কাজ ছিল কেবল তা গ্রহণ করা। এই দক্ষতার ক্ষেত্রে কেবল সেটা করলে আর চলবে না। একজন শিক্ষার্থীকে নিজ চেষ্টায় সহপাঠী, শিক্ষক ও টেক্সট বইয়ের সঙ্গে মিথস্ট্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে এই দক্ষতা অর্জন করে নিতে হবে।
তবে সহপাঠীদের ভূমিকা, বিশেষ করে তাদের বৈচিত্র্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সহপাঠীদের মধ্যে যত বৈচিত্র্য থাকবে, একজন শিক্ষার্থীর আবেগীয় ও মনোপেশিজ দক্ষতা আহরণ সহজ হবে। একইভাবে ওদের মধ্যে বৈচিত্র্য কম থাকলে একজন শিক্ষার্থীর সেগুলো শেখার সুযোগ তত সংকুচিত হবে। যেমন একটা স্কুলে যদি আগের মতো শুধু একাডেমিক অর্থে ভালো শিক্ষার্থীদের সমাবেশ ঘটে, তাহলে তাদের পক্ষে আবেগীয় ও মনোপেশিজ দক্ষতা অর্জন কঠিন হবে। গুণগত শিক্ষার জন্য চাই বৈচিত্র্য। পৃথিবীবিখ্যাত শিক্ষাবিদ স্যার কেন রবিনসনের মতে, এই বৈচিত্র্যই শিক্ষার্থীদের শেখার ক্ষমতা বাড়ায়। সরকার যদি এই বৈচিত্র্যের প্রতি নজর দেয়, তাহলে অন্তত শিক্ষার্থীর দিক থেকে স্কুলগুলোর মধ্যে সমতা আনতে খুব একটা সময় লাগবে না, যা গুণগত শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রধান পূর্বশর্ত।
গুণগত শিক্ষা অর্জনে এই সমতা যে কতটা প্রয়োজন তা ছোট একটা ঘটনা উল্লেখ করলে স্পষ্ট হবে। শিক্ষা নিয়ে লেখেন বা কথা বলেন যে ক'জন শিক্ষাবিদ পৃথিবীবিখ্যাত, তাদের মধ্যে ফিনল্যান্ডের পাসি সাহলবার্গ অন্যতম। তিনি একবার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া গেলেন। তাঁর মতো মানুষ কোনো দেশে গেলে শিক্ষা সম্পর্কিত কর্তাব্যক্তিরা তাঁর কাছে পরামর্শ চাইবেন, সেটাই স্বাভাবিক। সেখানেও তাই হলো। ঠিক পরামর্শ নয়, তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হলো, শিক্ষায় ফিনল্যান্ডের চাইতে অনেক বেশি বিনিয়োগ করার পরও অস্ট্রেলিয়া পিছিয়ে আছে কেন? থতমত খেয়ে পাসি সাহলবার্গ বললেন, দেখ, আমি তো নতুন এসেছি। সবকিছু জানি না। তবে এসেই যে দুটি বিষয় আমার ফিনিশ চোখে অদ্ভুত ঠেকেছে, সে দুটি বিষয়ে একটু বলি।
প্রথমত, এখানে এসে আমার বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর সময় যখন জানলাম, তাদের স্কুল-টিফিন আমাদেরই তৈরি করে দিতে হবে, তখনই একটা ধাক্কা খেলাম। কারণ ফিনল্যান্ডে কোনো বাচ্চা টিফিন নিয়ে স্কুলে যায় না। স্কুল কর্তৃপক্ষ সবার টিফিনের ব্যবস্থা করে। আর দ্বিতীয় যে বিষয়টি আমাকে অবাক করল সেটি হচ্ছে, এখানে আসার পরপরই আমার সহৃদয় সহকর্মীরা স্বপ্রণোদিত হয়ে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে যে পরামর্শটি দিলেন সেটা হচ্ছে, আমার বাচ্চাদের কোন স্কুলে ভর্তি করলে ভালো হবে। আমার অবাক হওয়ার কারণ হচ্ছে, ফিনল্যান্ডে এই বিষয় নিয়ে কেউ কখনও কোথাও আলোচনা করে না। অস্ট্রেলীয় শিক্ষা কর্মকর্তাদের ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছে দেখে সাহলবার্গ বিষয়টি আরও খোলাসা করে বললেন, দেখুন, প্রথমত আমাদের ওখানে এক স্কুলের সঙ্গে আরেক স্কুলের কোনো পার্থক্য নেই এবং দ্বিতীয়ত, একজন শিক্ষার্থী যে মানের বা যে ধরনেরই হোক না কেন, সে অবধারিতভাবেই তার বাসার পাশের স্কুলটিতে ভর্তি হবে। ফলে এ নিয়ে কোনো আলোচনা সেখানে অবান্তর।
সাহলবার্গ আরও বললেন, অস্ট্রেলিয়ার পিছিয়ে থাকার আরও অনেক কারণ থাকতে পারে, তবে এ দুটিই যথেষ্ট। আরও স্পষ্ট করে বললে, অস্ট্রেলিয়ানরা তাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যতদিন এই সমতাটুকু আনতে পারবে না, ততদিন তাদের কাছে ফিনল্যান্ডের মতো গুণগত শিক্ষা অধরাই থেকে যাবে। শিক্ষাবিষয়ক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৪ অর্জন করতে হলে আমাদেরও তাই করতে হবে।
আমাদের সুবিধাটা হচ্ছে, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনেক আগেই জাতির মননে এই সমতার বিষয়টি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। সমতার কথা বলেই তিনি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, সংগ্রাম করেছেন এবং স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। সেই একই ধারায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে, শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করে, বৃত্তি দিয়ে, অবকাঠামো তৈরি করে, শিক্ষা সরঞ্জাম প্রদান করে, বিনামূল্যে টেক্সট বই সরবরাহ করে কিংবা গত দু'বছর ধরে লটারির মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এখনও এই সমতা নিয়ে আসার কাজ অব্যাহত। কিছু ক্ষেত্রে দৃশ্যমান সাফল্যও এসেছে। বিশেষ করে নারী-পুরুষের সমতার ক্ষেত্রে। যেমন মাধ্যমিকে শুধু যে ৪৬ শতাংশ ছেলের বিপরীতে ৫৪ শতাংশ মেয়ে পড়ে, তাই নয়; তাদের লেখাপড়ার মানও কোনো ক্ষেত্রে ছেলেদের সমান এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে ভালো। যেমন সম্প্রতি মাউশি থেকে প্রকাশিত ন্যাস-১৯ নামক গবেষণাপত্রে দেখা যায়, গণিতে মেয়েরা ছেলেদের সমান, কিন্তু বাংলা ও ইংরেজিতে তারা ছেলেদের চাইতে সামান্য হলেও অগ্রবর্তী।
কিন্তু এই একই গবেষণাপত্রে যখন গ্রাম-শহর, সমতলভূমি- অন্যান্য অঞ্চল এবং সাধারণ স্কুল-মাদ্রাসার তথ্য-উপাত্ত নিয়ে তুলনামূলক বিশ্নেষণ করা হয়েছে, তখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকট পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে। যেমন সমতল রাজশাহী বিভাগের শিক্ষার্থীরা বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে হাওর ও পাহাড় অধ্যুষিত সিলেট বিভাগের শিক্ষার্থীদের চাইতে অনেক ভালো করেছে। একইভাবে শহরের চাইতে গ্রামের কিংবা সাধারণ স্কুলের চাইতে মাদ্রাসার ছেলেমেয়েরা পিছিয়ে আছে। তবে এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, প্রণোদনা পেলে গ্রামের শিক্ষার্থীরা যে নিজ চেষ্টায় অন্তত বাংলা বিষয়ের ক্ষেত্রে শহরের শিক্ষার্থীদের কাছাকাছি চলে আসতে পারে, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেমন ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণিতে এ দুই অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের মধ্যে পার্থক্য দশম শ্রেণিতে এসে অনেক কমে যায়। এসএসসি পরীক্ষায় ভালো করতে হবে- এটা ভেবে প্রণোদিত হয়ে গ্রামের শিক্ষার্থীরা নিজ চেষ্টায় এই পার্থক্য কমিয়ে আনতে পারে। কিন্তু ইংরেজি ও গণিত নিজে নিজে শিখতে পারে না বলে এ দুটি বিষয়ে তারা দশম শ্রেণিতে গিয়ে আরও পিছিয়ে যায়। যেমন এক গবেষণায় দেখা গেছে, ষষ্ঠ শ্রেণিতে বাংলায় দুই অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কেল স্কোরের পার্থক্য ৩০। কিন্তু দশম শ্রেণিতে তা কমে প্রায় অর্ধেক, অর্থাৎ ১৭ হয়েছে। উল্টোদিকে, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ইংরেজিতে একই রকম পার্থক্য, অর্থাৎ ৩০ থাকলেও দশম শ্রেণিতে গিয়ে তা বেড়ে ৪৫ হয়েছে। এতে কেবল দুই অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের অসমতাই প্রকাশিত হয় না; গ্রামাঞ্চলে যে ভালো ইংরেজি ও গণিত শিক্ষক নেই, তাও স্পষ্ট হয়।
গুণগত শিক্ষা বাস্তবায়ন করতে হলে শিক্ষায় সমতা আনার জন্য সরকার ইতোমধ্যে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তা দ্রুত আরও বেগবান করতে হবে। না হলে তথাকথিত মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে একাডেমিক অর্থে আরও ভালো কিছু শিক্ষার্থী হয়তো বেরোবে, কিন্তু তাদের নিয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে পৌঁছানো দুস্কর।
সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক: মাউশির সাবেক মহাপরিচালক, অধ্যাপক ও ফলিত ভাষাতত্ত্ববিদ
মন্তব্য করুন