পাঁচ বছর আগে ১৯ মে আমি এবং বাংলা টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ সামাদুল হক (আমার স্বামী) আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে লন্ডন থেকে ঢাকায় নিয়ে আসি। সোনারগাঁও হোটেলে তাঁর হাত দিয়েই বাংলাদেশে উদ্বোধন হয় স্যাটেলাইট টেলিভিশন বাংলা টিভির। আমাদের টেলিভিশনের ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে- গাফ্ফার ভাই নেই। ১৭ মে বিকেলেও তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। বাংলা টিভির ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্র পাঠালাম গাফ্ফার ভায়ের মেয়ে চিন্ময়ী চৌধুরীর হোয়াটসঅ্যাপে। চিন্ময়ী আপা সেই আমন্ত্রণপত্র হাসপাতালে নিয়ে গাফ্ফার ভাইকে দেখালেন। উপস্থিত থাকতে পারুন বা না পারুন, আমি প্রতিবছরই তাঁকে দাওয়াত দিই। বাংলাদেশ থেকে কারও দাওয়াত বা চিঠি পেলে অথবা কোনো বাঙালিকে পেলে গাফ্ফার ভাই অনেক খুশি হতেন। আমার দাওয়াতপত্রটি পেয়েও তাঁর মনটা প্রফুল্ল হয়েছিল। এর পর আমার সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। আমি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর জন্য তাঁর শুভেচ্ছা বক্তব্য (বাইট) চাইলাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি চিন্ময়ী আপাকে বললেন- ফোন অন কর। তিনি বাইট রেকর্ড করে পাঠালেন। পাঠানোর পর আমাকে ফোন করে বললেন- শব্দ ও ছবি ঠিক আছে কিনা। আমি বললাম- সব ঠিক আছে। এটা সম্প্রচারের পর আপনাকে পাঠিয়ে দেব।
এখানে বলে রাখি, গাফ্ফার ভায়ের সদ্য প্রয়াত মেয়ে বিনিতা চৌধুরী বিনু আমার বান্ধবী। আমি গাফ্ফার চৌধুরীকে ভাই বললেও তাঁর মেয়েদেরও আপা বলতাম। বিনিতার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের কথা গাফ্ফার ভাই ভালোভাবেই জানতেন। বিনুর অকাল মৃত্যুর পরই মূলত গাফ্ফার ভাই বেশি ভেঙে পড়েন। আগে থেকেই তিনি আমাকে নিয়মিত ফোন করতেন। তবে বিনুর মৃত্যুর পর প্রায় প্রতিদিনই সকালে নাশতা করে আমাকে ফোন করতেন। ফোন করে বলতেন-বিনু মারা যাওয়ার পর আমি তোমার মাঝে ওকে খুঁজে পাই। আমার বারবার ফোনে তুমি কি বিরক্ত হও? আমি ধন্য যে গাফ্ফার ভায়ের কাছে পিতৃস্নেহ পেয়েছি। তিনি বলতেন- তোমার সঙ্গে কথা বলে মনে শান্তি পাই। তাঁর পরিবারের অনেক না-বলা কথাও অনায়াসে আমার সঙ্গে শেয়ার করতেন। আমিও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম একজন বাবার সেই কথাগুলো। অসুস্থ হওয়ার পর বিনু তাঁকে কীভাবে চলতে বলতেন, কীভাবে যত্ন নিতেন, সেই কথা বলতে পেরে তাঁর মন ভরে যেত, তৃপ্তি পেতেন। একজন মাদ্রাসাপড়ূয়া ছাত্র কীভাবে প্রগতিশীল হয়ে উঠলেন; লেখক থেকে সাংবাদিক হওয়া। বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক-সব বিষয়ে আমার সঙ্গে লম্বা সময়জুড়ে কথা বলতেন। আমি তাঁকে আত্মজীবনী লিখতে অনুরোধ করলে তিনি রাজিও হয়েছিলেন। ঢাকা থেকে ফোনে কথা বলে একজন এ-কাজটি শুরুও করেছিলেন।
হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে ২০ মে বাসায় ফেরার কথা ছিল 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি'- এ অমর গানের স্রষ্টার। কিন্তু বাসায় ফেরা নিয়ে আগের মতো উৎফুল্ল ছিলেন না গাফ্ফার ভাই। তিনি আমাকে বললেন, কোন বাসায় যাব? ওই বাসায় তো আমার বিনিতা নেই। কে আমাকে মুখে ক্রিম লাগিয়ে দেবে? ওষুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে? আমার যত্ন নেওয়ার মানুষটা তো পরপারে চলে গেছে। আসলে বিনিতা চৌধুরীর মৃত্যুশোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি।
গাফ্ফার ভাই আমাকে অসম্ভব রকম স্নেহ করতেন। তিনি আমাকে মেয়ের আসনে বসিয়েছেন। আমিও তাঁর মতো বাবার কাছ থেকে যে স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি; সে ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারব না। তাঁর মৃত্যুতে অভিভাবক হারানোর শূন্যতা অনুভব করছি।
গত বছরের ২০ ডিসেম্বর লন্ডনের বাসায় গাফ্ফার ভায়ের সঙ্গে আমার সরাসরি সাক্ষাৎ হয়। সে সময় লন্ডনে ওমিক্রন ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই আমরা সরাসরি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎটা এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মনোবলের দিক থেকে অসম্ভব রকম তরুণ গাফ্ফার ভাই বলতেন- এসব করোনা আমার হবে না। হলে আগেই হতো। তুমি জামাইকে নিয়ে আবার কবে আসবা? আমি বললাম, ৩০ ডিসেম্বর আমরা ঢাকা ফিরব। পরে আবার লন্ডন এসে আসব। তিনি রাজি হলেন না। বললেন, ৩০ তারিখের আগে আবার আসবা। এরই মধ্যে আমার স্বামীর ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ায় নির্দিষ্ট দিনে আর ঢাকা ফেরা হয়নি। এটা শুনে গাফ্ফার ভাই অট্টহাসি দিয়ে বললেন, আমার অভিশাপ লেগেছে। বলছি না আমার বাসায় আসতে? আসতে চাওনি বলে আটকে গেছ। এ রকম প্রাণখোলা হাসি আর দেখব না- এটা ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়। বিষাদের ছায়া নেমে আসে। গাফ্ফার ভাই নেই, বিনীতা নেই- একদিন আমরা কেউই থাকব না। কিন্তু একুশের অমর গানের রচয়িতার মৃত্যু নেই। যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে ততদিন তিনি অমর।
ড. দিনাক সোহানী: পরিচালক, বাংলা টিভি
মন্তব্য করুন