বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। এ দেশে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান- এ চারটিই প্রধান ধর্ম। উল্লেখ্য, এ চার ধর্মের কোনোটিই বাংলাদেশের আদি ধর্ম নয়। হিন্দু ধর্মের সঙ্গে এ দেশের মানুষের পরিচয় ঘটেছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। এরপর বৌদ্ধ ধর্ম এসেছে আড়াই হাজার বছর আগে, ইসলাম ধর্ম এসেছে প্রায় হাজার বছর আগে এবং খ্রিষ্টধর্ম এসেছে প্রায় ৬০০ বছর আগে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এ চার ধর্মকেই মমতার বাহুডোরে বেঁধেছেন তাঁর 'সাম্যবাদী' কবিতার রজ্জু দিয়ে- 'যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব ব্যবধান,/যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম খ্রিষ্টান।'
আবহমান কাল থেকে বাংলা ভূখণ্ডে নানা জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্মমতের অনুসারীরা পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে মিলেমিশে একত্রে বসবাসের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বা আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির ঐতিহ্য সংহত রেখেছে। তাই বলা চলে এ দেশটি সুদূর অতীত থেকেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে। বিশেষ করে বঙ্গীয় অঞ্চলে ইসলামের আবির্ভাবের মাধ্যমে প্রায় হাজার বছর ধরে ধর্মীয় সম্প্রীতির ভিত আরও সুদৃঢ় হয়েছে। কেননা, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনপদে অমুসলিম সংখ্যালঘু মানুষদের সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানের অপরিহার্য দায়িত্ব হলো মুসলমানদের; বাংলার মুসলমানরা যুগ যুগ ধরে সেই দায়িত্ব ধর্মীয় চেতনাবোধের আলোকে পালন করে চলেছেন। আমাদের দেশে মসজিদের পাশে মন্দির, ঈদ ও পূজা উদ্‌যাপন হয়; একইসঙ্গে আজানের ধ্বনির পাশাপাশি মন্দিরে বাজে বাঁশরির সুর। আধুনিক বাংলাদেশের সব্যসাচী লেখক ও কবি সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন, 'একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি,/ আজো একসাথে থাকবোই/ সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।'
বাংলাদেশের সব ধর্মাবলম্বী মানুষ ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় পালন করে থাকে তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় উৎসব; একের উৎসবে যোগ দেয় ভিন্ন ধর্মের অনুসারীরাও। এভাবেই বাঙালির ধর্মীয় উৎসবগুলোও সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়। এ দেশে যেমন মুসলিমদের জন্য মসজিদভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে, ঠিক তেমনি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্যও সরকারি অর্থায়নে মন্দিরভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠাগার চালু রয়েছে; বৌদ্ধ ধর্মগুরু জ্ঞানতাপস অতীশ দীপঙ্করের নামে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, গঠন করা হয়েছে খ্রিষ্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট আর উপজাতি অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলে রয়েছে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ও জাতিগত নানা কেন্দ্র- রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ও ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ও ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত এসব ধর্মীয়, সামাজিক ও শিক্ষামূলক কেন্দ্রের সরব উপস্থিতি এবং গতিশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির প্রত্যাশিত রূপটিই ফুটে ওঠে। কবি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার সেই চেতনার আলোকেই গেয়েছেন- 'বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালি।'
মুসলিম হজযাত্রীর সেলাইবিহীন ইহরামের সাদা কাপড়ের মতো বৌদ্ধ ভিক্ষুর সেলাইবিহীন হলুদ কাপড়, হজযাত্রীর মাথা মুণ্ডন আর বৌদ্ধ ভিক্ষুর মাথা নেড়েকরণ, হিন্দুদের কাছে গঙ্গাজল যেমন পবিত্র, ঠিক মুসলমানদের কাছে জমজম কূপের পানি পবিত্র, শ্রীলঙ্কার রত্নাগিরি পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত পদচিহ্নকে মুসলমানরা মনে করেন হজরত আদম (আ.)-এর পায়ের ছাপ আর হিন্দুরা মনে করেন তাদের শিব-দেবতার ছাপ, মুসলমানদের ইসলাম ধর্মের 'ইসলাম' মানে যেমন শান্তি, অনুরূপ হিন্দুদের ধর্মের মূলমন্ত্রও হলো 'ওম শান্তি' অর্থাৎ বিশ্বের সবাই শান্তিতে থাকুক। মহানবী (সা.) মক্কার হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন থেকে নবুয়ত লাভ করেন আর গৌতম বুদ্ধ নিরঞ্জনা নদীর তীরে অশ্বত্থ বৃক্ষের ছায়াতলে ধ্যানমগ্ন থেকে বুদ্ধত্ব তথা মহাজ্ঞান লাভ করেন, সকল ধর্মেই পাপের শাস্তি নরক আর পুণ্যের পুরস্কার স্বর্গ- এ ধরনের অজস্র মিল খুঁজে পাওয়া যাবে ধর্মগুলোর তুলনামূলক পর্যালোচনায়। অন্যদিকে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম নিছক বিধি-নিষেধ ও আচার-অনুষ্ঠানের সমষ্টি নয়; এরা আসলে শিল্প ও দর্শনের সমন্বয় বিশেষ।
আমরা দেখতে পাই, পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলো এক স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসী। সকল বিশ্বাসী আবার একই সূত্রে গ্রথিত। বিশ্বাসীর সংখ্যা অনেক কিন্তু বিশ্বাস এক। এই বিশ্বাসই আমাদের জন্য আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির বড় উৎস হতে পারে। এ বিশ্বাসেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত মুক্তি আসতে পারে। এ ছাড়া আমাদের গভীর জ্ঞানের পূজারি হতে হবে এবং সকল মানুষকে জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কেননা জ্ঞানের গভীরতাই আমাদের সত্যিকার ঐক্য এনে দিতে পারে এবং সকলের মাঝে সম্প্রীতি স্থাপন করে দিতে পারে।
ভিন্ন ধর্ম, দর্শন, মতবাদ বা সম্প্রদায়ের মানুষের সমন্বয়ে যে সমাজ গড়ে ওঠে তাই সহাবস্থানের সমাজ। রবীন্দ্রনাথের মতে, ধর্ম হচ্ছে সরলতা ও পূর্ণতার একমাত্র চরমতম আদর্শ। কিন্তু সেই ধর্মকেই মানুষ সংসারের সর্বাপেক্ষা জটিলতা দ্বারা আকীর্ণ করে তুলেছে। ফলে সৃষ্টি করছে নব নব সম্প্রদায়ের। সেই ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় ও মতবাদের সংঘর্ষে জগতে বিরোধ-বিদ্বেষ অশান্তি-অমঙ্গলের আর সীমা নেই। এমন হলো কেন? এর একমাত্র কারণ, সর্বান্তকরণে আমরা নিজেকে ধর্মের অনুগত না করে, ধর্মকে নিজের অনুরূপ করার চেষ্টা করেছি বলে। আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির বাঙালি সমাজের স্বার্থে আমাদের নবী-রাসুল থেকে শুরু করে অলি-আবদাল, গাউস-কুতুব, সুফি-সাধক, পীর-মাশায়েখ, কবি-সাহিত্যিক, দার্শনিক-ঐতিহাসিক, রাজা-বাদশাহ, সমাজ সংস্কারকসহ মানবেতিহাসের আদর্শস্থানীয় মনীষীদের জীবন-দর্শনকে নিজেদের রচনা ও কর্মে, চিন্তা ও চেতনায় এবং অনুসারী ভক্তকুলের জন্য প্রদত্ত নির্দেশনায় সুশোভিত ও বাগ্ধময় করে তুলতে হবে।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন: চেয়ারম্যান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়