এক সময় ফুটবল খেলোয়াড় সামাদকে তাঁর চাতুর্যের জন্য ফুটবল জাদুকর বলা হতো। আজ ক্রীড়া আলোচনাতে তিনি বিস্মৃত। গামা পালোয়ান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বিস্কোকে ইংল্যান্ডে গিয়েই পরাজিত করে আসেন। গামা ছিলেন খানদানি পালোয়ান পরিবারের। অর্থাৎ কুস্তিই তাঁর পেশা। গামার যখন বাবা মারা যান তখন তাঁর ৮ বছর বয়স। অন্নের অভাব ছিল না। অভাব ছিল উপযুক্ত কুস্তি শিক্ষকের। তাঁর বাবার বন্ধু মাধো সিং ছিলেন পাঞ্জাবের নামকরা মল্ল। তাঁর হাতে পড়ে গামার কুস্তির উন্মেষ হয়। গামার ছোট ভাই ইমাম বকশ্‌কে গামাই তৈরি করেন। গামার পর ইমামই ছিলেন শ্রেষ্ঠ মল্ল।
১৯০৯ সালে লাহোরে দু'জন প্রতিভাবান মল্লের নাম ছড়িয়ে পড়ে- একজন গামা, অন্যজন মুহিউদ্দিন। গামা ৮ মিনিটে মুহিউদ্দিনকে পরাজিত করার সঙ্গে সঙ্গে মল্লজগতে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ল।
তখন বিশ্বশ্রেষ্ঠ কুস্তিগিরদের প্রতিভার প্রকাশ হতো। বিশ্বশ্রেষ্ঠের জন্য নির্ধারিত ছিল 'জনবুল বেল্ট', ইংল্যান্ডে বড় বিস্কোর কোমরেই তা শোভা পেত। গামার প্রতিভা দেখে তাঁকে ইংল্যান্ড নিয়ে গেলেন শরৎকুমার ও নামকরা কুস্তিগির গোবর বাবু। সঙ্গে ইমাম বকশ এবং আরও কুস্তিগির গিয়েছিলেন। তাঁদের ম্যানেজার ছিলেন এক ইংরেজ আর. বি. বেঞ্জামিন। গামাদের আগে আরও দুইবার ভারতীয় মল্ল দল ইংল্যান্ড গিয়েছিল।
গামার দলকে অগ্রাহ্য করছিল ইংল্যান্ডের মল্লরা। অনেক চেষ্টায় ডাক্তার রোলারের সঙ্গে গামার কুস্তির ব্যবস্থা হলো। রোলার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পদবি তিন মাসের জন্য নিজের কাছে রেখেছিলেন। রোলার যে গামাকে পরাজিত করবেন- এ ব্যাপারে ইংল্যান্ডের মানুষ নিশ্চিত ছিল। তবে গামা যখন ৫/৬ মিনিটেই রোলারকে পরাজিত করলেন, সমগ্র ইংল্যান্ড স্তম্ভিত হয়ে গেল। এর পর জন লেম, যিনি ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন, তাঁর সঙ্গে গামা না লড়ে গামার ছোট ভাই ইমাম বকশ লড়লেন। ইমাম তাঁকে ছোট ছেলের মতো করে বেশ ক'বার আছাড় দিলেন। জন লেম কখনোই এত অল্প সময়ে এভাবে হারেননি। গামার নাম হলো 'পাঞ্জাব কেশরী' আর ইমামের 'প্যান্থার'। গামা কখনোই প্রতিপক্ষকে অকারণে আঘাত করতেন না। তিনি জানতেন, তাঁর হাতে যে শক্তি আর লুক্কায়িত যে চাতুরী রয়েছে তাতে যে কোনো মল্ল হারবেন। কী দরকার আহত করার? তবে ইমাম প্যান্থারের মতোই ক্ষিপ্র, চতুর, নির্মম ও অমোঘ। তাঁর হাতে প্রতিপক্ষের নিস্তার নেই।
বিশ্বজয়ী হতে গামাকে খুব বেশি লড়তে হয়নি। কারণ তিনি ছিলেন মল্লজগতের 'হারকিউলিস'।
তবে বিদেশি কুস্তিগির পরাজিত করা আর ভারত-কুস্তি আসরে শ্রেষ্ঠ হওয়া এক নয়। ভারত জয় করতে হলে মল্লবীর রহিমকে হারাতে হবে।
এলাহাবাদে সেই বিরাট দঙ্গল হয়েছিল। একটা ঢালু প্রবেশপথ দিয়ে রহিম 'দীন দীন' রবে চিৎকার করে এলেন। সঙ্গে কালো আলপাকার কোট পরা রামমূর্তি। তবে আখড়ায় ঢুকলেন না। ভারতীয় মল্ল আসলে প্রবাদপুরুষ। তাঁর ব্যক্তিত্বকে সবাই শ্রদ্ধা করে। রামমূর্তি হাতি বুকে ওঠাতেন।
রহিমের সারা শরীরে গেরিমাটি মাখা। তাতে রহিমকে আরও আগ্রাসী দেখাচ্ছিল। উপস্থিতরা উত্তেজনা আর উল্লাসে ফেটে পড়ল। শুধু গামা, যিনি রহিমের আগেই আখড়াতে; কেননা, রহিম তখনও হিন্দুস্তানজয়ী। গামা আখড়ার এক কোণে হাত দোলাতে দোলাতে বৈঠক দিচ্ছিলেন; তা দিতেই থাকলেন।
আখড়ার একদিকে রইস, আমির, রাজাবৃন্দের জরিজোব্বার পোশাকে ভারতের গণ্যমান্যদের এক মহামিলন।
রহিম আখড়ার দড়ির ভেতর দিয়ে লাফিয়ে প্রবেশ করলেন। গামা নিজের পাগড়ি ও কামিজ দূরে নিক্ষেপ করলেন। ফুটে উঠল এক গ্রিক পুরাণের দেবতার শরীর। গামার দেহের উৎকর্ষ তখন চমৎকার। প্রতিটি গতিতে তাঁর দেহের সুপ্ত শক্তি যেন জেগে উঠছে। এক নয়ন-আনন্দদায়ক শরীরের মালিক হলেন গামা।
রহিম আর গামার রেষারেষি ছিলই। খুব বেশিই ছিল। ওই সময় গামার এক মাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী রহিমই। তাঁরা হাত না মিলিয়েই কুস্তি শুরু করলেন।
শুরুতে বলেছিলাম ফুটবল জাদুকর সামাদের কথা। কাছাকাছিতেই সাঁতারু ব্রজেন দাস। আমাদের আধুনিকতার আবাহনে ব্রজেন দাসও হারিয়ে গেছেন। ক্রীড়াঙ্গনে তাঁদের উপেক্ষা মানে ক্রীড়া ঐতিহ্যকে ছুড়ে ফেলা। যোগ্যকে সম্মান দিন।
মেজর (অব.) সাহাবুদ্দিন চাকলাদার: জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত ও সাবেক অধিনায়ক, জাতীয় এবং  সেনাবাহিনী হকি দল