স্বরূপ প্রকাশিত
ইউরোপের চিঠি
দাউদ হায়দার
প্রকাশ: ১০ জুন ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১০ জুন ২০২২ | ১৪:২৫
বাংলাদেশে পরিচিত মুখ। সাংবাদিক মহলে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র বোদ্ধা। সমালোচক। একটি ইংরেজি দৈনিকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখনও আছেন অপ্রকাশ্যে। সপ্তাহে এক দিন ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান করেন ওই 'একটি' ইংরেজি দৈনিকেরই পক্ষ থেকে। বিষয় নানাবিধ।
তিনি শ্রীশ্রী রবিশঙ্করের আন্তর্জাতিক যোগ (ইয়োগা) সংস্কৃতির সঙ্গেও যুক্ত। বিদেশে গুরুর (শ্রীশ্রী রবিশঙ্কর) প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠান, সম্মেলনে হাজির। তাঁর কাঁধেও দায়িত্ব।
বছর কয়েক আগে বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রিত। পরিচয় তখন। জানতুম নানা গুণে গুণান্বিত তিনি। তাঁর বিষয়ে ফিরিস্তি শোনান বার্লিনের একজন সংগীতশিল্পী।
গত মাসের প্রথম সপ্তাহে কথিত গুণীজন ঢাকা থেকে ফোনে বললেন, বার্লিনে আসবেন। থাকবেন দিনকয়েক জার্মান বন্ধুর আস্তানায়। স্বাগতম জানালুম।
এলেন। সঙ্গে উপহার। একটি দৈনিকের ঈদসংখ্যা। সুখী হলুম। আরও সুখ একটি টি-শার্ট। গাঢ় সবুজ। বুক-পেটের অংশে লাল অক্ষরে লেখা বাংলাদেশ। ইংরেজি। পিঠের অংশেও। বাইশ লাইন। শাদা অক্ষরে। শব্দমালায় বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। টি-শার্টের দুটি কাগজ। প্রস্তুতকারক :আমার বাংলাদেশ।
স্লোগান মুদ্রিত :'আমরা সময়কে রাঙিয়ে তুলি'। কৌতূহল তুঙ্গে। পড়লুম :"প্রতিটি পণ্যই এক টুকরো বাংলাদেশ। 'রঙ বাংলাদেশ'-এর এই সাব-ব্র্যান্ডে রয়েছে কান্ট্রি ব্র্যান্ডিংয়ের সচেতন প্রয়াস।
স্মারক উপহার বা স্যুভেনির সামগ্রীই এই কালেকশনের মূল বৈশিষ্ট্য। এর মাধ্যমে থাকছে দেশি এবং বিদেশিদের কাছে পজিটিভ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবিকে তুলে ধরার প্রচেষ্টা। বেশ। লক্ষ্য করুন। এর মধ্যে কতগুলো ইংরেজি শব্দ। বাংলা প্রতিশব্দ উধাও। ক্রেতার কাছে এই বয়ান মূল্যবান? বুঝবেই না সাব-ব্র্যান্ড, কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং কী জিনিস।
বিদেশি যদি ক্রেতা, বাংলায় লেখা ইংরেজি শব্দ পড়তে পারবে? ইংরেজিতেও বয়ান, কিন্তু একেবারেই ভিন্ন। বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি গায়েব।
কলকাতায় থাকাকালীন একটি নামি বিজ্ঞাপন সংস্থায় কপি রাইটারের চাকরি, পণ্যের বিজ্ঞাপনে সংক্ষিপ্ত কী লিখতে হবে তালিম নিয়ে এক মাসে সতেরোটি লিখেছি, ঊর্ধ্বতন কর্তারা একটিও পছন্দ করেননি। বেতন ঠিকই পেয়েছি। এক বছর পাঁচ মাস। পোক্ত হওয়ার পরে আরেক সংস্থায়। তিনটি লিখলে একটি পাস। কপি রাইটারের একটি বয়ান যদি মোক্ষম হয়, ক্রেতার মনে ধরে পণ্যের বিক্রি বেড়ে যায়। মনেও রাখে কৌতুকবশত। আলোচিত। যেমন, যৌনশক্তিবর্ধক ভায়াগ্রা বেরিয়েছে সদ্য। বিশ্বজুড়ে হইচই। ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষের পি আর (পাবলিক রিলেশনস) বিজ্ঞাপন দিলে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্য-প্রান্ত থেকে যেসব ট্রেন আগ্রা হয়ে দিল্লি আসবে : 'ভায়া আগ্রা।'
কখন কী ভাষায় বিজ্ঞাপন, সময়কালে, পণ্যের বাজারে, কপি রাইটারের মগজে পরিস্কার না হলে ব্যবসা লাটেও ওঠে। সাংবাদিক বললেন, বিজ্ঞাপনের চুম্বক অল্পকথা।
লক্ষ্য করি, পথে যেতে যেতে বিজ্ঞাপনের প্ল্যাকার্ডে, হোর্ডিংয়ে চোখ রাখেন। মডেল, বিজ্ঞাপনের ছবি দেখেন।
ঘুরছেন শহরের নানা প্রান্তে। প্রশ্ন জাগে তাঁর মনে :'আচ্ছা, আমরা কোথায়? বার্লিনে না ইউক্রেনে?'
সংগত প্রশ্ন। ইউক্রেন নিয়ে কোনো বিজ্ঞাপন নয়। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ইউক্রেনের পতাকায় সয়লাব। জার্মান জাতীয় পতাকাও প্রায় অদৃশ্য। দেশটা যেন ইউক্রেন।
ঐতিহাসিক বার্লিন আলেক্সজান্ডার প্লাৎস (চত্বর)-এর অন্যতম দ্রষ্টব্য কার্ল মার্ক্স-এঙ্গেলসের বিশাল পাথরের মূর্তি ঢেকে দিয়েছে, চৌহদ্দিতে যাওয়ার উপায় নেই, কাঠের দেয়ালে ঘেরা।
কার্ল মার্ক্স-এঙ্গেলসের যুগল মূর্তি দেখতে দেশ-বিদেশের দর্শক। দুই মহাত্মার মূর্তি রাশিয়ার পক্ষে জনমত তৈরি করবে, পশ্চিমার ইউক্রেন প্রেমে কাঁটা দেবে? জার্মান সরকারের গায়ে আরও বেশি?
রাশিয়ার পক্ষে কেউ কথা বললে শত্রু। কমিউনিস্টরাও মৌনী। দৈনিক ডী টাৎস (বার্লিন-হামবুর্গ-ব্রেমেন থেকে প্রকাশিত)। থোড়াই কেয়ার করে। জার্মানিসহ পশ্চিমার ভণ্ডামি কোন পর্যায়ে তথ্যপ্রমাণাদি জানাতে অকুতোভয়। বিপদেও পড়েছে। বিজ্ঞাপন নেই।
বলা হয় জার্মানি গণতন্ত্রের, মানবাধিকার, মিডিয়ার, বাক-স্বাধীনতার দেশ। তাই? মিডিয়ায় সেন্সর মাত্রায়? টিভি, রেডিওর খবর দেখলে, শুনলেই মালুম হয় 'গোপন কথাটি রবে না গোপনে।'
ইউরোপের (ইইউ, ব্রিটেন বাদ) সাতাশটি দেশের মধ্যে ইউক্রেন নিয়ে জার্মানির দরদ উথলে পড়ছে বেশি। আর্থিক, অস্ত্র সাহায্যে তো আছেই, ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধে পরামর্শ দাতাও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানি নাকে খত দিয়েছিল কোনো যুদ্ধে জড়িত হবে না। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ। এখন কী দেখছি? পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষের সীমা ছাড়িয়েছে।
জার্মানির বিভিন্ন রাজ্যে ইউক্রেনের উদ্বাস্তু কয়েক লাখ, বার্লিনে লক্ষাধিক। তাদের দরদে নিদ্রাহীন। আর্থিক সাহায্য ছাড়াও বাড়িঘর দিচ্ছে। দিয়ে ধন্য।
বার্লিনে ষোলোটি জেলা। প্রত্যেক জেলার (রাটহাউস নামে পরিচিত) সামাজিক অফিস, সাহায্যকারী অফিস (নাগরিকদের জন্য) ইউক্রেন নিয়ে মশগুল। বাড়িঘর দিচ্ছে। নিজের ঘরের বাসিন্দা ফেলনা। বার্লিনের রাস্তায়-ফুটপাতে অগুনতি মানুষের রাত্রিযাপন। গৃহহীন।
আফগান উদ্বাস্তুদের ঘরবাড়ি দেওয়া হয়েছিল মানবিকতার অছিলায়। কোথায় গেল মানবিকতা? বারো হাজার আফগান উদ্বাস্তুকে (উদ্বাস্তু পরিবারকে) সরিয়ে, মাঠের তাঁবুতে ঢুকিয়ে, ইউক্রেন শরণার্থীদের ঠাঁই দিয়েছে আফগানদের আবাস কেড়ে নিয়ে। সরকার বলছে, 'এটা সাময়িক'। মানবিকতা তা হলে স্থায়ী নয়? সাময়িক?
এ রকম গুঞ্জরণ (যেহেতু গুঞ্জরণ, সত্যতা যাচাই অসম্ভব), জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস (এসপিডির) কোণঠাসা, বিপদগ্রস্ত। আরও দুই দল নিয়ে তাঁর কোয়ালিশন সরকার। কোয়ালিশনের বড় শরিক শাসিয়েছে, আমাদের কথায় উঠবস না করলে সরকার ভেঙে দেব। বড় শরিকের চোখে রাশিয়া গরল, বিষ। রাশিয়াকে শায়েস্তা করতে আদাজল খেয়ে মরিয়া। ওলাফ শলৎস একূল-ওকূল রক্ষায় ঢেঁকির তাল বেতাল।
তিন মাসের বেশি ভোজ্যতেল উধাও (আসত রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে)। পোয়াবারো অলিভ তেলের। পাঁচগুণ দাম।
রান্না, ভাজি, আলু ভর্তাও খেতে হচ্ছে তেল ছাড়া। ভালোই। ভেজিটেরিয়ান। সাংবাদিক বললেন, 'ইউরোপের আসল চরিত্র পরিস্কার, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিমিত্তমাত্র। ইউরোপের স্বরূপ প্রকাশিত।'
দাউদ হায়দার: কবি
- বিষয় :
- ইউরোপের চিঠি
- দাউদ হায়দার