রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী এল এ চৌধুরীর ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। ঐতিহাসিক ৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক ও শেরেবাংলা প্রতিষ্ঠিত কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি ছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে আল হেলাল নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন এবং পরে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রাম জেলা বোর্ডের সদস্য ছিলেন। তা ছাড়া তিনি চট্টগ্রাম গুল-এ-জার বেগম গার্লস হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও উন্নয়নের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন। এমইএস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি, সোসাইটি অব আর্টস অ্যান্ড লিটারেচার, চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ, চট্টগ্রাম সাহিত্য বক্তৃতা পরিষদ, চট্টগ্রাম বিভাগীয় শহর উন্নয়ন প্রকল্পের চেয়ারম্যান, ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ ও যক্ষ্ণা সমিতির উপদেষ্টা ছিলেন। আল কোরআন কেন্দ্র, গহিরা হাই স্কুল অ্যান্ড মাদ্রাসাসহ বহু শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

ষাটের দশকে এল এ চৌধুরী রচিত 'ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ও জনগণ' নামক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।

৭১-এর অগ্নিঝরা স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ২২ মার্চ ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বৈঠক চলছিল। ওই দিন চট্টগ্রামের রেলওয়ে পোলোগ্রাউন্ড ময়দানে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক জনসমুদ্রে ভাষণ শেষে চট্টগ্রাম সফরের এক পর্যায়ে এল এ চৌধুরীর দেওয়ানবাজারের বাসভবনে যান। সেখানে সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের সর্বদলীয় নেতৃবৃন্দ মওলানা ভাসানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তাঁরা জনগণের একমাত্র প্রাণের দাবি বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে ঐতিহাসিক মতবিনিময় সভায় যোগদান করেন এবং একাত্মতা ঘোষণা করেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ঠিক এই সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মওলানা ভাসানীকে ফোন করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে অবহিত করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের প্ররোচনায় অসুস্থ ও বৃদ্ধ বয়সে এই প্রবীণ রাজনীতিবিদকে তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

স্বাধীনতা লাভের পর এল এ চৌধুরীর প্রস্তাবনায় ও পরিকল্পনায় সমাজের সর্বস্তরের রাজনৈতিক, সমাজসেবী, গবেষক ও আলেম সমাজের প্রতিনিধি নিয়ে প্রথম শ্রম ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী, চট্টগ্রামের জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে 'ইসলামী শিক্ষা ও সমাজকল্যাণ সম্মেলন' আয়োজনের পদক্ষেপ গ্রহণ একটি জরুরি ও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হয়েছে। ফলে সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ইমাম ও আলেম সমাজ এবং অন্যান্য ধর্মের পুরোহিত তথা প্রধানদের দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে রেখে ধর্মশিক্ষা প্রচলন ও দুস্থ মানবতার কল্যাণ সাধনের জন্য সুপ্রশস্ত পথ তৈরিতে পৃথক সেক্রেটারিয়েট গঠন ও স্থাপনের লক্ষ্য ছিল।

১৯৮৮ সালে দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও রাজনীতি-সচেতন নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করে চট্টগ্রামে বৃহত্তর চট্টগ্রামের স্বার্থ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে পরিচালিত সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান 'বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন গণসংগ্রাম কমিটি' গঠিত হয়। এই সংগঠনের উদ্যোগে যে ক'জন বরেণ্য ব্যক্তিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে মরহুম এল এ চৌধুরীকে (লুৎফে আহমেদ চৌধুরী) শিক্ষা, সমাজ ও জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মরণোত্তর 'চট্টগ্রাম পদক' প্রদান করা হয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় চট্টগ্রাম মহানগরীর দেওয়ানবাজার দিদার মার্কেট থেকে সিঅ্যান্ডবি ব্রিজ পর্যন্ত লেনকে 'বিশিষ্ট সমাজসেবক ও দানবীর মরহুম এল এ চৌধুরীর সড়ক' নামে নামকরণের জন্য সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং চট্টগ্রামের তৎকালীন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ২০২০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ওই সড়কের উদ্বোধন করেন। রাজনীতি ও সমাজসেবায় অসামান্য অবদানের জন্য এল এ চৌধুরী স্মরণীয় হয়ে আছেন। মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

মেসবাহউদ্দিন জঙ্গী চৌধুরী: প্রকাশক, টইটম্বুর মাসিক শিশু-কিশোর পত্রিকা