এ দেশের জনগণ নির্বাচন নিয়ে আন্দোলন করেছে সবচেয়ে বেশি, কিন্তু নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে পর্যালোচনা করেছে সবচেয়ে কম। নির্বাচন ব্যবস্থা যেমন হবে, তার ওপরই নির্ভর করে কেমন প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। নির্বাচনের ইতিহাস দীর্ঘ। পাকিস্তান আমলে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, ১৯৫৪ সালে গণপরিষদে সংবিধান প্রণয়নের জন্য একটি বিল ২৯-১১ ভোটে পাস হয়। কিন্তু বিলটি বাস্তবায়নের আগেই ২৪ অক্টোবর তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ও প্রেসিডেন্ট গণপরিষদ ভেঙে দেন। পরে ফেডারেল কোর্টের আদেশে দ্বিতীয় গণপরিষদ গঠিত হয়। এই দ্বিতীয় গণপরিষদ ১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংবিধান গ্রহণ করে এবং ২৩ মার্চকে সংবিধান প্রবর্তন দিবস ঘোষণা করে। পাকিস্তানকে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। হয় মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার। পূর্ব ও পশ্চিম থেকে উভয় সংখ্যক সদস্যকে নিয়ে ৩০০ সদস্যের জাতীয় পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা রাখা হয়। ১০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়। ২১ বছর বয়সী সব নাগরিকের সরাসরি ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা হয়।

নির্বাচন পরিচালনা, ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং অন্যান্য নির্বাচনী তত্ত্বাবধায়ক পরিচালনার জন্য সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতির পরামর্শে প্রেসিডেন্ট একজনকে 'প্রধান নির্বাচন কমিশনার' হিসেবে নিয়োগের বিধান করা হয়। কমিশনের মেয়াদ ছিল তিন বছর। কিন্তু প্রথমে মির্জা ইস্কান্দার ও পরে আইয়ুব খান ক্ষমতা নিয়ে একটি কমিশন বানান। কমিশন রিপোর্ট করে, পাকিস্তানের জনগণ রাষ্ট্রপতি কিংবা জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচনের যোগ্যতাসম্পন্ন নয়। চালু করা হয় 'মৌলিক গণতন্ত্র'। এই ব্যবস্থায় ৮০ হাজার সদস্য সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হতেন এবং তাঁরা রাষ্ট্রপতি এবং জাতীয় ও স্থানীয় পরিষদকে নির্বাচিত করতেন।

আইয়ুবের পতনের পর ২৮ নভেম্বর ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া ঘোষণা দেন- 'এক ব্যক্তি এক ভোট'। নির্বাচনের জন্য তিনি 'লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার' জারি করেন। বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও অধিকাংশ দল নির্বাচনে অংশ নেয়। আওয়ামী লীগ ৬ দফাকে জনসমর্থনের ভিত্তি ঘোষণা করে।

১৯৭১ সালে জনযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু গণপরিষদ গঠন করা হয় পাকিস্তানের ধরনে। ব্রিটিশদের অধীনে ১৯৪৬ সালে নির্বাচিতদের যেমন স্বাধীন পাকিস্তানের গণপরিষদ সদস্য করা হয়; তেমনি মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে গণপরিষদ সদস্য করা হয় ১৯৭০ সালে ৬ দফাভিত্তিক যাঁরা সংবিধান প্রণয়ন করতে চেয়েছিলেন।

তার পর স্বাধীনতার এক বছরের মাথায় ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর নতুন সংবিধান গ্রহণ করা হয়। ভেঙে দেওয়া হয় গণপরিষদ। ঘোষণা করা হয় প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের। ১৯৭৯ সালে সামরিক শাসনের অধীনে হয় দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। শাহ আজিজুর রহমান সংসদীয় নেতা ও আসাদুজ্জামান খান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিরোধীদলীয় নেতা হন। তারপর আসেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত গণআন্দোলনের মুখে পতন ঘটে তাঁর।

স্বাধীন বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো সরকারের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈধভাবে পতন ঘটে। তাঁর আগে সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে সরকারগুলোর বিদায় ঘটেছে। কেউ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিদায় নেননি। কারণ, নির্বাচন কমিশন নয়, রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীই নির্ধারণ করেন নির্বাচনের পরিবেশ। তাই আন্দোলনকারী সব শক্তির মধ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে বোঝাপড়া হচ্ছিল। কিন্তু শেষে সবকিছু ছাপিয়ে যায় 'অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রশ্ন'।

তারপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়। বিএনপি ও আওয়ামী জোট দু'বার করে ক্ষমতায় আসে। তারপর ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হয় এবং আওয়ামী লীগ এক যুগের বেশি ক্ষমতায় আছে। সশস্ত্র ধারাকে মোকাবিলা ও অনুগতদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ ছিল ব্রিটিশদের এই নির্বাচনী পদ্ধতি। আর এদিকে নির্বাচনী ব্যবস্থার সুফল ভোগ করেছে শাসকগোষ্ঠী। নির্বাচন ব্যবস্থায় বাংলাদেশকে ৩০০টি আসনে ভাগ করা হয়। প্রতিটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্তকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। অন্য প্রার্থীদের ভোটদাতাদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ নেই। রেকর্ড বলছে, ৩০-৪০ শতাংশ ভোটপ্রাপ্তরা সরকার গঠন করে আর বাকি ভোটাররা প্রতিনিধিত্বহীন থাকে। গঠিত হয় সংখ্যালঘিষ্ঠের সরকার। কিন্তু প্রচার হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সরকার গঠিত হয়েছে।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাচিত হওয়ার পর দলীয় সংসদ সদস্যরা আর জনগণের প্রতিনিধি থাকেন না। আইন অনুযায়ী তাঁরা দলীয় প্রতিনিধিতে পরিণত হন। বলা হয়, সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। আইন ও সংবিধান অনুযায়ী সরকারপ্রধান কারও কাছে দায়বদ্ধ থাকেন না। উল্টো দলের সদস্যরা সরকারপ্রধানের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। এটাই সমস্যা। জনগণের কাছে জবাবদিহিহীন নির্বাচনী ব্যবস্থা বজায় রেখে যে নির্বাচন চাই, তা দিয়ে ক্ষমতার দৈত্যরাই সংসদ দখল করে নেবে। পূর্বসূরিরা যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, তা কেমনে হবে?

নাহিদ হাসান: লেখক ও সংগঠক
nahidknowledge@gmail.com