- মতামত
- প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে রিট ও কিছু প্রশ্ন
শিক্ষা
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে রিট ও কিছু প্রশ্ন

স্যার ফজলে হাসান আবেদের (১৯৩৬-২০১৯) সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয়েছে বেশ কয়েকবার। শেষ যেবার সাক্ষাৎকার নিয়েছি, নিউজ ম্যাগাজিন 'সাপ্তাহিক' সম্পাদক গোলাম মোর্তোজার সঙ্গে যৌথভাবে; তা প্রকাশিত হয়েছিল ২০১০ সালের ২০ মে। তখন তাঁর সঙ্গে আলাপ তুলেছিলাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে দরিদ্র মানুষের সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে নেওয়া তো প্রায় অসম্ভব। গরিব মানুষের জীবনমান পরিবর্তনই ব্র্র্যাকের মূল টার্গেট। অথচ টাকার কারণেই গরিব মানুষের ছেলেমেয়েরা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারবে না। এটা কি নীতিগত দ্বৈততা হয়ে গেল কিনা? স্যার ফজলে হাসান আবেদ খুব ঠান্ডা চিন্তার মানুষ ছিলেন। কথাও বলতেন শান্ত স্বরে। তিনি জানালেন, একটা মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয় বানানো দরকার, যাতে সৎ, ভালো একটা নতুন প্রজন্ম গড়ে ওঠে। কোয়ালিটিতে কোনো আপস করা যাবে না। ফলে এখানে পড়তে খরচ একটু বেশি হবেই। তাঁর ভাষায়, 'আমাদের এখানে গরিব ছাত্রছাত্রীরাও পড়ছে। আমি বেশ কিছু টাকা জোগাড় করেছিলাম গরিব ছাত্রছাত্রীদের জন্য। যারা কোনো ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারে না। এমনকি যাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও যাওয়ার মতো সামর্থ্য নেই। থাকা-খাওয়ার জন্য হাজার দুয়েক টাকা লাগবে, সেটাও নেই। তাদের শুধু ফ্রি এডুকেশনই দিই না, তাদের আবার প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে দিই, যাতে করে সে থেকে-খেয়ে-পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে পারে।' ফজলে হাসান আবেদের এই মডেলটা আমার মনে ধরেছিল।
হঠাৎ এসব ঘটনা ও কথা মনে পড়ল সংবাদপত্রে আদালতের একটা খবর দেখে। বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ৩০ মে এক রিটের প্রাথমিক শুনানির পর রুলসহ আদেশ দেন। আদেশে বলা হয়েছে, দেশের ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কতজন দরিদ্র শিক্ষার্থী পড়ার সুযোগ পেয়েছেন, সেই সংখ্যাসহ এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গবেষণার জন্য কত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সে তথ্য আদালতকে জানাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানকে ৬০ দিনের মধ্যে ওইসব বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। আগামী ১৪ আগস্ট শুনানির পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন আদালত। জনস্বার্থে এই রিটটি করেছেন কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের পক্ষে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন। রিট আবেদনকারীর উদ্বেগ হচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৯(৪) ধারা ও ৯(৬) ধারা উপেক্ষিত হচ্ছে; সঠিকভাবে মানা হচ্ছে না।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের এই দুই ধারায় কী আছে, সেটাও বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর ৯(৪) ধারায় শতকরা ৩ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা ও ৩ ভাগ দরিদ্র শিক্ষার্থীর পড়ার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ যাঁরা এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন বানিয়েছেন, তাঁরা খুব যথার্থভাবেই মোট শিক্ষার্থীর ৬ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং প্রান্তিক দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিনা খরচে পড়ার সুযোগের আইনি ভিত্তি বাধ্যতামূলক করেছেন। শুধু তাই নয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যাতে গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ করতে বাধ্য থাকে, সেটারও আইনি বিধি সুনির্দিষ্ট করে রেখেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখভাল করার আপাতত ক্ষমতা দেওয়া আছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে। এতটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যাদের পরিচালনাকারীরা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট ক্ষমতাবান; তাদের বিধিমতো চালানোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পক্ষে সহজ কাজ নয়।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চ শিক্ষার বিকাশে এক বড় ভূমিকা রাখছে। না হলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ার একটা বড় অংশ হয়তো বিদেশে পড়তে যেত। ফলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যেত। এখন এ কারণে খরচ করা দেশের অর্থ দেশেই থাকছে। অন্যদিকে বিদেশে বড় বড় ডিগ্রি নেওয়া দেশে কাজ করতে ইচ্ছুক প্রবাসী বাংলাদেশির একটা বড় অংশ এখানে শিক্ষকতা করার সুযোগ পাচ্ছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটা বড় অংশের কর্মসংস্থান আমাদের দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখছে। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুণগত মানে বেশ এগিয়েও গেছে।
তবে এটা মনে রাখতে হবে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কোনো চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান নয়। মুনাফার জন্যই বিনিয়োগ করা হয় এখানে। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে, শিক্ষা আর দশটা ব্যবসার মতো নয়। এটা চাল বা তেলের ব্যবসা নয়। এখানে তৈরি হয় একটা দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব। ফলে এখানে অনেক বেশি আইনানুগ ও নৈতিক থেকে চলতে হয়। যদিও অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, শিক্ষা ব্যবস্থাপনার মান, অবকাঠামোগত সুবিধাদির মান, নানাবিধ খরচের পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রশ্ন আছে এসব প্রতিষ্ঠানের অনেক অসাধু মালিক-উদ্যোক্তার আর্থিক অনৈতিক আচরণ নিয়ে। প্রশ্ন আছে সনদপত্র প্রদানের জন্য যেসব শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলেছে, তা যথাযথভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা, সেটা নিয়েও।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কতগুলো মৌলিক ভাবনা তাই এখন জরুরি। যেমন- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে একজন শিক্ষার্থীর খরচ কত হবে? এটা কে নির্ধারণ করবে? কীভাবে এটা নির্ধারিত হবে? কোন মানদণ্ডে, কী বিবেচনায়, কত শতাংশ মুনাফার বিপরীতে, কত খরচ নেওয়া হবে, সেটাই বা ঠিক করবে কে? এই ঠিক করার কৌশলই বা কী হবে? কতদিন পর পর এর পুনর্মূল্যায়ন হবে?
আয় করে ব্যয় এবং মুনাফা নিশ্চিত করে, সব রকম আইন-বিধি মেনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করা একটা সহজ কাজ নয়। সে জন্য দরকার যুগোপযোগী উদ্ভাবন বা নতুন বিজনেস আইডিয়া।
এর জন্য নজরদারি বা তদারকির একটা শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে হেলা করার আর সুযোগ নেই। আদালতের এই রিট সম্ভবত সেই প্রয়োজনকে আরও বড় করে চোখের সামনে হাজির করল।
শুভ কিবরিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক
kibria34@gmail.com
মন্তব্য করুন