মাত্র দু'দিন পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচন। রোববার সমকালের এক প্রতিবেদনে যথার্থই বলা হয়েছে, নির্বাচনটি নিয়ে প্রার্থী-কর্মী-সমর্থক-ভোটার সবার মধ্যেই চলছে টানটান উত্তেজনা। মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা ছুটছেন ভোটারদের দ্বারে। বোঝা যাচ্ছে, কুমিল্লা মহানগর এলাকা এখন উৎসবের নগরী। প্রার্থীদের মধ্যে নানা বিষয়ে বিতর্ক বেশ ঝাঁজালো রূপ নিলেও এবং কখনও কখনও তা ব্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বড় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা সেখানে ঘটেছে বলে জানা যায়নি। তবে ভোটের দিন পর্যন্ত এমন পরিবেশ বজায় থাকবে কিনা- তা নিয়ে শঙ্কা অনেকেই প্রকাশ করেছেন। এরই মধ্যে সেখানে কোনো কোনো মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে কালো টাকা ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী, যিনি গত দুই মেয়াদে কুসিকের মেয়র ছিলেন; শাসকদলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশনের ভোটার নন এমন লোকদের নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সমবেত করার অভিযোগ করেছেন। বলা বাহুল্য, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলেও কুসিক নির্বাচনে তাদের দু'জন (বহিস্কৃত) নেতা স্বতন্ত্র প্রতীকে মেয়র পদে নির্বাচন করছেন। ফলে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা দু'ভাগ হয়ে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন।

এর আগের দুটি কুসিক নির্বাচন বেশ গ্রহণযোগ্য হলেও, এবারের নির্বাচন নিয়ে বিশেষ করে ভোটার ও স্বতন্ত্র দুই প্রভাবশালী প্রার্থীর মনে কিছু শঙ্কা কাজ করছে বলে আমরা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখেছি। শাসক দল এবার যে কোনো উপায়ে গত দু'বারের 'পরাজয়ের প্রতিশোধ' নিতে মরিয়া বলে অনেকেরই মনে হচ্ছে। তা ছাড়া, দেশে গত দুটি জাতীয় নির্বাচন এবং ২০১৪ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত যত স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার অধিকাংশেরই মান সম্পর্কে জনমনে ব্যাপক প্রশ্ন আছে। এসব নির্বাচনে একদিকে বিপুলসংখ্যক প্রার্থী দৃষ্টিকটুভাবে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ, মেয়র বা চেয়ারম্যান হয়েছেন; আরেকদিকে বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থী কর্তৃক প্রতিপক্ষকে মারধর, ভয়ভীতি প্রদর্শন, ব্যালট বাক্স ছিনতাই ও জালভোট প্রদানের মতো অনিয়ম ঘটেছে। এ সময়ে খুনোখুনিসহ নির্বাচনী সহিংসতার মাত্রা ছিল নজিরবিহীন। এমনকি রাতের বেলা ভোটের বাক্স ব্যালট দিয়ে ভর্তি করে রাখার অভিযোগও উঠেছে এসব নির্বাচনে। মোট কথা, একটা নির্বাচনকে প্রহসন বলতে যা যা লাগে তার সবই দেখা গেছে ওই নির্বাচনগুলোতে। আরও দুঃখের বিষয় হলো, ওই নির্বাচনগুলো যেসব কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে তারা এসব অনিয়ম স্রেফ চেয়ে চেয়ে দেখেছে। শুধু তাই নয়; সংবাদমাধ্যম ও নাগরিকদের তরফ থেকে যখন এসব অনিয়মের প্রতি তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বা কোনো নির্বাচন কমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে তখন হয় ঘটনাগুলো অস্বীকার করা হয়েছে, নয় তা ঠেকাতে তাঁদের কিছুই করার নেই বলে জবাব দেওয়া হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটেই কুসিক নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা- তা নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের তো বটেই, জনমনেও এক ধরনের সংশয় অস্বাভাবিক নয়।

আমরা মনে করি, কুসিক নির্বাচন নিয়ে সব শঙ্কা ও সংশয় দূর করার দায়িত্ব বর্তমান নির্বাচন কমিশনের। গত মার্চে দায়িত্ব গ্রহণকালে সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনাররা বলেছিলেন, তাঁরা তাঁদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শুধু প্রার্থী বা ভোটার নয়; নির্বাচনের সব অংশীজনের আস্থা অর্জন করবেন। তাঁরা তখন এও বলেছিলেন, গত দুটি নির্বাচন কমিশনের লিগ্যাসি থেকে তাঁরা বেরিয়ে আসবেন। তাঁদের ওই কথাগুলো কি স্রেফ কথার কথা, নাকি কাজের কথা, তা প্রমাণের একটা বড় সুযোগ হলো কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। কারণ, কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে এটাই প্রথম বড় নির্বাচন। সব মহলের চোখ এখন এই নির্বাচনের দিকে। কুসিক নির্বাচন কমিশনের জন্য একটা অ্যাসিড টেস্ট। এখন পর্যন্ত নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলতে প্রার্থীদের তাঁরা ভালোই বাধ্য করতে পেরেছেন। তবে এটাও ঠিক, নির্বাচনী আচরণবিধি ভাঙার দায়ে স্থানীয় সাংসদকে অবিলম্বে এলাকা ছাড়তে তাঁদের দেওয়া নির্দেশ এখনও মান্যতা পায়নি। আমরা মনে করি, শাসক দল যা-ই ভাবুক; অন্তত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের দৃঢ়তা একটা সুষ্ঠু ভোটের নিশ্চয়তা দেয়। কুসিক নির্বাচন তা আবারও প্রমাণ করবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।