হতাশা মাঝেমধ্যেই সেলিব্রেটিদের আত্মহত্যার কারণ হয়। কখনও কখনও সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির বিপুল ব্যবধানও আত্মঘাতী হওয়ার কারণ। অনেক সময় আত্মঘাতী না হলেও বিষণ্ণতা অনেকের জীবন বিষিয়ে তোলে। এ মানসিক সংকট থেকে উত্তরণে ধ্যান বা মেডিটেশন খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখে। কিন্তু এই সেবাও আর আগের খরচে পাওয়ার সুযোগ থাকছে না। আরও অনেক সেবার সঙ্গে মেডিটেশনের ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আরোপ করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী ৯ জুন সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ প্রস্তাব করেন।

মেডিটেশন সেবাকে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী উল্লেখ করে যদিও এর আগের বছরগুলোর বাজেটে মূসক অব্যাহতির প্রস্তাব করা হয়েছিল। জনগণের মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোবল অটুট রাখার স্বার্থে মেডিটেশন সেবার ওপর মূসক অব্যাহতির প্রস্তাব বেশ সমাদৃত হয়। 'কভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন' স্লোগান নিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে। মহামারির এই অভূতপূর্ব ক্রান্তিকালে সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, নিউজিল্যান্ডের মতো ক'টি দেশ ছাড়া অন্য দেশগুলো অতি ব্যতিক্রমহীনভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভঙ্গুরতা ঢাকতে পারেনি। অতি মনোযোগের মৌলিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যখন এই হাল, তখন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করার সময় কোথায়! মানসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় মেডিটেশনই ভরসা।

লাখো মানুষের আস্থা এখন ধ্যানে। এর সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন আগ্রহীরা। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, বিশ্বের ৫০ কোটি মানুষ এখন নিয়মিত মেডিটেশন করে। আধুনিক ব্যস্ততাতাড়িত জীবনের ওয়ার্ক স্ট্রেস, হতাশা ও বিষণ্ণতা কাটিয়ে উঠে সফল ও তৃপ্ত জীবনের জন্য নিয়মিত মেডিটেশনের সমকক্ষ আর কিছু নেই- এই বাস্তবভিত্তিক ধারণা থেকে উন্নত বিশ্বে মেডিটেশন কার্যক্রম এখন মূলধারার চর্চার বিষয়। হার্ভার্ড, ইয়েল, এমআইটি, স্ট্যানফোর্ডের মতো নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট ও হ্যাপিনেস কারিকুলাম সামনে রেখে বিভিন্ন কোর্স চালু আছে।

বিশ্বজুড়ে করোনা আক্রান্ত হয় এক বিশাল জনগোষ্ঠী। আর করোনায় আক্রান্ত হয়নি সেই জনগোষ্ঠীর মানসিক সংকটের কারণ হচ্ছে, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভীতি, চলমান নাগরিক জীবনে হঠাৎ স্থবিরতা ও সামাজিকতাবিহীন আপাত বন্দি জীবন, লকডাউনজনিত অর্থনৈতিক মন্দাভাব, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। এসব জেঁকে বসা সমস্যা কাটাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ভার্চুয়াল মিডিয়ার প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা স্থবির জীবনে পারিবারিক অশান্তি ও অস্থিরতা তৈরি করেছে। আরবান, নন-আরবান বিশাল জনগোষ্ঠীর মনোজগতের ওপর তৈরি হওয়া এ বিরূপ প্রভাবের প্রতিকার ও মোকাবিলা এখন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ভাবনার বিষয়।

করোনায় সুস্থ ও পুনর্বাসনের দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং রোগীর প্রতি সামাজিক বিরূপ আচরণ বেশ পীড়াদায়ক। আইসোলেশনে থাকা রোগাক্রান্ত ব্যক্তি দীর্ঘ সময় পরিবার থেকে দূরে থেকে একাকী জীবনযাপন সুস্থ ও অসুস্থ সবাইকে মানসিক কষ্টে রেখেছে। সহমর্মিতার এমন নিদারুণ সংকট আর দেখা না দিক। তবে বিপরীত ব্যতিক্রমকে মনে রাখতে চাই মৃতের সৎকারে কিছু সংগঠনের আন্তরিক সেবা আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে সাহায্যের কত যে সত্য গল্প আছে। এসব সত্য গল্পে আছে জীবনের সামূহিক প্রকাশ।

এই করোনাকালে অনেক পরামর্শ বা প্রটোকলই নানাভাবে বদলেছে মিউটেট করা ভাইরাসটির মতোই। তবে একটি বিষয় অপরিবর্তিত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও ইমিউন (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) সিস্টেম ভালো থাকলে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠা যায় এবং এতে ধ্যান (মেডিটেশন) অর্জিত মনোবল সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। মেডিকেল সায়েন্স বলে, মানুষের রোগের ৭৫ শতাংশই হচ্ছে মনোদৈহিক। নিয়মিত মেডিটেশন এই ৭৫ শতাংশ রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে। এভাবে মেডিটেশন আমাদের স্বাস্থ্যব্যয় কমাতে পারে। মেডিটেশন সঠিক জীবনদৃষ্টির অনুশীলন করলে ৪০ শতাংশের বেশি চিকিৎসা ব্যয় কমাতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন চিকিৎসার যে গাইডলাইন প্রকাশিত হয়েছে, তাতে মেডিটেশনের পরামর্শ আছে। জীবন স্বাস্থ্যের জন্য এমন উপকারী ধ্যান সেবাকে ভ্যাটের আওতামুক্ত রেখে রাষ্ট্র কল্যাণমুখী পরিচয় নির্মাণের সুযোগ নিক।

এম এম খালেকুজ্জামান: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

adv.mmkzaman@gmail.com