এক মাসের ব্যবধানে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ল সিলেট মহানগর। গত মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের নেমে আসা পানিতে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি উপচে পড়য় সিলেট মহানগরীর উপশহরসহ অন্তত ২০টি এলাকা বন্যার কবলে পড়ে। এ সময় সুরমা ও কুশিয়ারা ডাইক ভেঙে জকিগঞ্জ-কানাইঘাটসহ উভয় নদীর অববাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। এ বন্যা ছিল আকস্মিক ও অকাল। কারণ সিলেট অঞ্চল সাধারণত জুন থেকে আগস্ট মাসে বন্যার শিকার হয়। পরিবেশবাদী ও নদী বিশেষজ্ঞরা সেই অকাল ও আকস্মিক বন্যার জন্য নদীর তলদেশে কয়েক মিটার পুরু পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য জমে যাওয়াকে দায়ী করেছিলেন। নদী খননের অভাবে সুরমা ও কুশিয়ারার নাব্য হারানোও ছিল এ বন্যার জন্য দায়ী।

এবারের বন্যায় সিলেট বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এর আগে কোনো বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা একই সঙ্গে প্লাবিত হওয়ার নজির নেই। সিলেট এবং ভারতের মেঘালয়, আসাম ও ত্রিপুরাতে অতিভারি বৃষ্টিতে সিলেট বিভাগের সব নদীই বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদনদীর ১০৬টি পয়েন্টের মধ্যে ৮৬টিতেই পানিপ্রবাহ বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে, এবার চেরাপুঞ্জিতে ১২২ বছরের মধ্যে রেকর্ড বৃষ্টি হয়েছে। ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বন্যার রেড অ্যালার্ট জারি করে জনগণকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের দেশে যেভাবে ঘূূর্ণিঝড়ের আগে জনগণকে সতর্ক করা হয় ও উদ্ধার কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়; ভারত তা করেছে। ভাটি ও নদীমাতৃক দেশ এবং এশিয়ার উজানের দেশগুলোর পানি বঙ্গোপসাগরে যাওয়ার ড্রেনখ্যাত বাংলাদেশে বন্যা হবে- এটিই স্বাভাবিক। অথচ আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেও বন্যার পূর্বাভাস দিয়ে রেড বা ইয়েলো অ্যালার্ট দিয়ে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর সতর্কতা জারির ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি।

এবারের বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হচ্ছে সুনামগঞ্জ জেলা। যুক্তরাজ্যের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র থেকে জানানো হয়, সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ১ মিটারের বেশি উচ্চতায় ও প্রতি সেকেন্ডে ১২ হাজার ঘনমিটারেরও বেশি পানি প্রবাহিত হচ্ছে। স্বাধীনতার পর সুনামগঞ্জ এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। হবিগঞ্জ শহর ও আজমিরীগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতিও ভয়াবহ। মৌলভীবাজারবাসীকেও নিদারুণ কষ্ট ও দুর্ভোগে ফেলেছে এবারের বন্যা। সিলেটের অনেক এলাকা স্মরণকালের মধ্যে প্রথমবারের মতো বন্যার অভিজ্ঞতা নিল। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি ও বর্তমানে পড়াই, সেই শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় কখনও এবারের মতো বন্যা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি।


বাংলাদেশে অতিবৃষ্টি হবে; উজানের দেশ ভারত থেকে ভাটির দেশে পানি নেমে আসবে- এগুলো স্বাভাবিক ঘটনা। তাই একটা সময়ের জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হওয়াই স্বাভাবিক। এ জন্য আমাদের দেশে জালের মতো নদী-নালা ও খাল-বিল ছড়িয়ে রয়েছে। রয়েছে সাত জেলায় বিস্তৃত সুবিশাল হাওর। তাই পানি আসবে আর ঘণ্টা বা বড় জোর দিনের ব্যবধানে এসব জলাধারে পানি নেমে আসবে, যা হওয়া ছিল বাস্তবতা। কিন্তু এসব নদী ও খালের অনেকটিরই অস্তিত্ব নেই। অনেক বড় বড় নদী নাব্য হারিয়ে যাওয়ায় দখল ও অপরিকল্পিত বালু তুলে অস্তিত্বের সংকটে ফেলা হয়েছে। হাওরে একের পর এক বাঁধ নির্মাণ; আড়াআড়ি সড়ক নির্মাণ; হাওর দখল করে জনবসতি ও সরকারি স্থাপনা নির্মাণ করে পানির আধার সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। বিদেশি সংস্থাগুলোর অপরিণামদর্শী পরামর্শ মোতাবেক নদী-নালার ওপর বক্স কালভার্ট নির্মাণ করে এদের গতিপথ সংকুচিত করার পাশাপাশি দখলবাজদের উস্কে দেওয়া হয়েছে।

শোষণকারী পাকিস্তান আমলেও আমাদের নদী ও খালগুলোতে নৌ-চলাচল উপযোগী সেতু নির্মাণ করা হতো। অথচ স্বাধীন দেশে আমাদের নদী, খাল-বিল ও হাওর নিশ্চিহ্ন করার মাধ্যমে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ডেকে নিয়ে আসছি। বন্যায় বারবার দুর্গতদের জন্য অর্থ খরচ না করে ঘটনার মূলে আঘাত করে স্থায়ী সমাধানের জন্য মানুষের আচরণ ও সরকারের যুগোপযোগী ভূমিকা দেখতে চাই। জিডিপি বা মাথাপিছু আয় বাড়ানো একবিংশ শতাব্দীর উন্নয়ন নয়; বরং মানব নিরাপত্তা নিশ্চিতের মধ্যেই উন্নয়নের মূলধারা নিহিত।

ড. জহিরুল হক শাকিল: অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
jahirul-psa@sust.edu