স্বাস্থ্যসেবার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জনগণের স্বাস্থ্যের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ উন্নয়ন। এ উদ্দেশ্য অর্জনের কৌশল কী হবে? প্রথমত, বর্তমানে যে সমস্যাগুলো বর্ণিত স্বাস্থ্যসংশ্নিষ্ট উদ্দেশ্য অর্জনে বাধা তা চিহ্নিত করা। এটা আমরা চারটি মৌলিক অংশে ভাগ করতে পারি। স্বাস্থ্য সমস্যা, এর কারণ বা ঝুঁকি ইত্যাদির প্রতিরোধ, প্রতিকার, নিয়ন্ত্রণ ও প্রয়োজনে পুনর্বাসন। প্রতিরোধের আবার স্তর আছে- প্রাথমিক প্রতিরোধ, যা রোগ যাতে না হয় তা নিশ্চিতকরণ। মাধ্যমিক প্রতিরোধ, যা রোগ হওয়ার পর সেটা যাতে জটিল আকার ধারণ না করে তার প্রতিরোধ। রোগে যাতে মৃত্যু না হয় সেটাকেও কার্যক্রম নির্দিষ্ট করার স্বার্থে আমরা চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রতিরোধ বলতে পারি। রোগের চিকিৎসাই প্রতিকার। রোগের নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রযুক্ত নয়। এই কার্যক্রম রোগের সামগ্রিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। যা জনপদে বা দেশে যাতে একটি নির্দিষ্ট রোগ না হয়, বা বিস্তৃত না হয়, তার ঝুঁকি না থাকে বা নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে লক্ষ্যে পরিচালিত হয়।

এখন কথা হলো, বিবৃত উদ্দেশ্যের আলোকে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার মূল কৌশল কী হওয়া উচিত, যার ভিত্তিতে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের উদ্দেশ্য অর্জিত হবে? কৌশল প্রণয়নের কতগুলো উপাদান থাকে, যা বাজেটকৃত কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয়। বাজেট শুধু অর্থের সংস্থান বা একটা সীমার মধ্যে প্রয়োজনীয় সম্পদের নিশ্চয়তা প্রদান করে। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য সেই সম্পদ দক্ষতার সঙ্গে ব্যয় করতে হবে। অর্থ ব্যয় আর দক্ষতার সঙ্গে অর্থ ব্যয় সমার্থক নয়। দক্ষতার সঙ্গে ব্যয় করার মূল শর্ত হলো, দক্ষভাবে প্রণীত কার্যক্রম ও বাজেট। এতদুদ্দেশ্যে অগ্রগণ্যতার আলোকে কর্মসূচি বা কার্যক্রমের পরিকল্পনা হলো বাজেটের মূল স্তম্ভ, যা অল্প ব্যয়ে অধিক অর্জনে সহায়তা করে।

এখন দেখা যাক আমাদের দেশে কোন কোন স্বাস্থ্য কর্মকাণ্ড ও বাজেট অগ্রগণ্যতার দাবিদার। এ জন্য প্রথমেই যা আমাদের জানতে হবে তা হলো, কোন কোন সমস্যা আমাদের স্বাস্থ্যের লক্ষ্য অর্জনে বাধা এবং কোন কোন রোগ আমাদের সমস্যা। রোগ যেমন সমস্যা; রোগ সম্পর্কিত প্রতিরোধ, প্রতিকার, নিয়ন্ত্রণ এবং পুনর্বাসন কার্যক্রমের দুর্বলতা ও সমস্যা হতে পারে এবং আমাদের ক্ষেত্রে প্রকৃতই এসব সমস্যা বিদ্যমান। সেসব দুর্বলতার কারণ জানা ও তা দূর করা সংশ্নিষ্ট ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের পূর্বশর্ত, যার প্রতিফলন বাজেট প্রাক্কলনে থাকতে হবে, কিন্তু বাস্তবে যা দেখা যায় না।

সারা পৃথিবীতে স্বাস্থ্য ক্ষেত্র পরিচিত একটা জনবল ঘনীভূত সেক্টর হিসেবে। যেখানে বহুমুখী সেবা প্রদানকারীদের সংখ্যা নির্ধারিত হয় জনসংখ্যা এবং তাদের স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্নমুখী প্রয়োজনের আলোকে। এই বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদানকারীদের সংখ্যা বাংলাদেশে অত্যন্ত অপ্রতুল। প্রকৃতপক্ষে কোন ধরনের সেবা প্রদানকারীদের সংখ্যা কত হওয়া উচিত, সে ধারণাই আমাদের নেই। এ বিষয়ে সংশ্নিষ্টদের মধ্যে এখনও কোনো চিন্তার উন্মেষ ঘটেনি। যেহেতু ক্ষেত্রটি জনবলঘন, তাই জনবল যদি যথেষ্ট না হয় তাহলে সেবার মান ও পরিমাণ প্রয়োজনানুগ হবে না।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী স্বাস্থ্যসংশ্নিষ্ট এসডিজি বিশেষত এসডিজি-৩ অর্জনের জন্য প্রতি হাজার জনগণের জন্য প্রয়োজন ৪ দশমিক ৫ জন সেবা প্রদানকারী; যার অনুপাত হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আরেক প্রস্তাবনা অনুযায়ী যথাক্রমে ১:৩:৫ জন চিকিৎসক, সেবিকা ও প্যারামেডিক। বাংলাদেশে এই সংখ্যা প্রতি হাজার জনগণের জন্য ৪ দশমিক ৫ জন সেবা প্রদানকারীর এক-তৃতীয়াংশ, যেখানে চিকিৎসকের হার শূন্য দশমিক ৬ প্রতি হাজার জনগণে। আর এর অনুপাত ১:০৫:০২। এই যখন বাস্তব অবস্থা, তখন স্বাস্থ্যসেবার মান বলুন আর পরিমাণ বলুন, এর কোনোটাই আপামর জনগণের প্রয়োজন পূরণ ও সন্তুষ্টি লাভে সমর্থ হবে না এবং স্বাস্থ্যসেবার উদ্দেশ্য অর্জনে সফল হবে না। ঘোড়ার সামনে গাড়ি জুড়লে ঘোড়া গাড়ি টানবে না। গাড়ি এক অনিচ্ছুক এবং অস্থির ঘোড়াকে টানবে। সেটা আমরা কেউই চাই না। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা ও বাজেটে এর কোনো প্রতিফলন আমরা দেখি না।

যেহেতু স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের সংখ্যাল্পতা আছে, তাই বাজেটে বার্ষিক সংকুলান থাকে পৌঃপুনিকভাবে বার্ষিক বাজেটের মোটামুটি ৫ শতাংশ। যেহেতু জনবল কম, তাই বাজেটও প্রয়োজনের নিরিখে কম। ফলে সেবা প্রদান কার্যক্রমের ধরন, পরিধি ও ব্যাপ্তিও কম। তাই প্রয়োজনীয় পরিমাণ ও মানের উপকরণাদি তথা যন্ত্রপাতি দেওয়ার সুযোগও সৃষ্টি হয় না। কিন্তু নীতিনির্ধারণী মহলে মতামত যেটি তৈরি হয় সেটা হলো, স্বাস্থ্য বিভাগের ব্যবস্থাপকরা অর্থ ব্যয় করতে অক্ষম। অর্থ ব্যয় করতে হলে প্রয়োজনের নিরিখে বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। অর্থাৎ যেখানে যা যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু বরাদ্দ করতে হবে। ব্যয় যাদের হাত দিয়ে বা যাদের ওপর ভিত্তি করে হবে, তাদের সংখ্যা যথাযথ না হলে, যথেষ্ট না হলে যথেষ্ট ব্যয় কীভাবে হবে? ব্যয় কার জন্য বা কার হাত দিয়ে হবে? সেবাই বা গুণগত বা পরিমাণগতভাবে যথেষ্ট কীভাবে হবে?

স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপকদের ব্যয়কুণ্ঠা যেসব কারণে ঘটে তার একটা বড় কারণ তাঁদের নিজেদের দক্ষতার সমস্যা নয় বরং জনবল নিয়োগ ও ক্রয়-সংক্রান্ত ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব, যা অনেক সময় কর্মকর্তাদের নিজস্ব কারণে হয় না।

আমাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বাজেটের আরেকটা দুর্বল দিক হলো, জনগণ যে স্বাস্থ্য সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ভোগে সে সম্পর্কে জনগণ এবং বাজেট প্রণয়নকারীদের ঔদাসীন্য বা ওইসব সেবার জন্য প্রাক্কলনভীতি। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষ অসংক্রামক রোগে মারা যায়। এসব রোগের চিকিৎসা ব্যয় বেশিরভাগই জীবনব্যাপী এবং অত্যধিক। কিন্তু বাজেটে এ জন্য বরাদ্দ বেশ কম।

স্বাস্থ্যহানিকর বা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ সম্পর্কে জনগণের জ্ঞান সীমিত। রোগ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য এই জ্ঞান প্রয়োজন। এই কর্মসূচিতে বাজেট বরাদ্দ ব্যয়ের তুলনায় অনেক বেশি ফলপ্রসূ। তাই জনঅবহিতকরণ কার্যক্রমে প্রয়োজন অনুযায়ী বাজেট বরাদ্দ থাকা বাঞ্ছনীয়। রোগের প্রাথমিক প্রতিরোধ পরবর্তী সময়ে রোগের পেছনে বিরাট পরিমাণের ব্যয় অনেক কমাতে পারে।

আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, স্বাস্থ্য শুধু নীরোগ শরীর বা বিকলাঙ্গতামুক্ত শরীর নয়; কর্মক্ষম উৎপাদনশীল শরীরও বটে। এ জন্য স্বাস্থ্যসংশ্নিষ্ট বাজেটকে পুষ্টিরও নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। এতদুদ্দেশ্যে বিশেষত কিশোরী, অন্তঃসত্ত্বা ও দুগ্ধদানকারী এবং বৃদ্ধ বয়সী, যাঁরা পুষ্টির অভাবে ভুগছেন, তাঁদের পুষ্টির নিরাপত্তা বিধান রাষ্ট্রের কর্তব্য, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছ থেকে উৎপাদনশীলতার নিশ্চয়তাও প্রদান করে।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার একটা বড় দুর্বল দিক হলো, পর্যানুসরণ (মনিটরিং), পরিবীক্ষণ (সার্ভেইল্যান্স) ও পর্যালোচনার দুর্বলতা। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কোন পথে যাচ্ছে, কী অর্জিত হচ্ছে আর কী হচ্ছে না; এ জন্য ব্যয় কত হচ্ছে, কোন লক্ষ্যে হচ্ছে, ব্যয়ের পরিমাণ বাজেটের আলোকে হচ্ছে কিনা, ব্যয়ে দক্ষতা নিশ্চিত হচ্ছে কিনা, বাজেট বরাদ্দের আলোকে উদ্দেশ্য অর্জিত হচ্ছে কিনা; না হলে কেন হচ্ছে না; হলে সেটা কি বরাদ্দের সীমার মধ্যে হচ্ছে; না হলে কেন হচ্ছে না, সেসব দিক সময় থাকতে পর্যানুসরণ ও পর্যালোচনার মাধ্যমে জানতে হবে। এসব সময়মতো না জানলে কোর্স কারেকশনের সময়োচিত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। সুতরাং এসব কার্যক্রমে বাজেট বরাদ্দ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বুঝতে হবে এবং স্বীকার করতে হবে, যে কাজ বা সেবার তত্ত্বাবধান এবং পর্যানুসরণ ব্যবস্থা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিহ্নিত দুর্বল দিক। এই কার্যক্রম শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ থাকতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের বাজেট কি এসব তথ্য, চিন্তা-ভাবনা এবং উদ্দেশ্য নিয়ে প্রাক্কলিত? আমরা কি আমাদের বাজেটে এসব অগ্রগণ্য দিকভিত্তিক প্রাক্কলন দেখতে পাই? নাকি আমরা থোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি থোড়- এই বাজেট প্রাক্কলন নীতিতে পরিচালিত?

ড. আবু মোহাম্মাদ জাকির হোসেন: জনস্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ববিদ

বিষয় : স্বাস্থ্য বাজেট আবু মোহাম্মাদ জাকির হোসেন

মন্তব্য করুন