ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ তিন মাস পেরিয়ে চতুর্থ মাসে গড়ালেও যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবে ইতোমধ্যে এ যুদ্ধের ভূ-কৌশলগত ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে এই যুদ্ধ শুরুর পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে যে পরিবর্তন আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাতে মনে হয় না যুদ্ধ-পূর্ব পৃথিবীতে আমরা আর কখনও ফিরে যেতে পারব। যুদ্ধরত দুটি দেশ ইউক্রেন ও রাশিয়া ছাড়াও যেসব দেশ এই যুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত, তারা আজ ব্যাপক আর্থসামাজিক সমস্যার সম্মুখীন। এমনকি হাজার মাইল দূরে অবস্থিত দেশগুলো; যুদ্ধে যাদের কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ স্বার্থ জড়িত নেই, তারাও যুদ্ধের কারণে ব্যাপক অর্থনৈতিক সমস্যায় নিপতিত।

বলা বাহুল্য, ইতোমধ্যে বৈশ্বিক অর্থনীতি করোনা-পরবর্তী সময়ে শ্নথাবস্থায় রয়েছে। এই যুদ্ধের পরিণতিতে তা শিগগিরই গভীর মন্দায় রূপ নেবে বলে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন। বৈদেশিক সহায়তা ও বিনিয়োগ কমে যাওয়া, রপ্তানি বাজার সংকুচিত হওয়া, আমদানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, রপ্তানি পণ্যের মূল্য হ্রাস, বেকারত্ব বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন আর্থসামাজিক সংকটের কারণে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো এক অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এ যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট দেখা দিতে পারে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা চালিয়েছে, তার কারণ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিনের ভাষায়, ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশের মাধ্যমে ইউক্রেন 'রেড লাইন' অতিক্রম করেছে, যা কিনা রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ। শীতল যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ রাশিয়া তার জন্য সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখেছে। যেখানে শীতল যুদ্ধের সময় ন্যাটের সীমানা মস্কো থেকে প্রায় ২০০০ কিলোমিটার দূরে ছিল; আর এখন পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া ও লিথুয়ানিয়ার মতো দেশ ন্যাটোভুক্ত হওয়ায় এ দূরত্ব ১০০০ কিলোমিটারেরও কমে চলে এসেছে। রাশিয়া মনে করছে, পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়াকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলছে।
রাশিয়া বারবার বহিঃশত্রুর আক্রমণের শিকার হয়েছে। রাশিয়ানরা মনে করে, তাদের বিশাল স্থলভূমি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে সুরক্ষার জন্য একটি অপরিহার্য অস্ত্র। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ভূখণ্ড হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়ার বহিঃসমুদ্রে প্রবেশদ্বার অত্যন্ত সীমিত। বাল্টিক সাগর থেকে আটলান্টিকের প্রবেশদ্বার জার্মানি, ডেনমার্ক ও নরওয়ের ন্যাটো বাহিনী দ্বারা ঘেরাওকৃত। কৃষ্ণ সাগর থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে যেতে হলে প্রথমে বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালি অতিক্রম করতে হবে, যা ন্যাটোর সদস্য তুরস্ক ও গ্রিস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং পরে জিব্রাল্টার প্রণালি পার হতে হবে, যা ব্রিটেন নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রশান্ত মহাসাগরের প্রবেশদ্বারে রয়েছে কোরিয়া, জাপান ও মার্কিন সেনা, বিমান ও নৌবহর। এসব কারণেই পশ্চিম ইউরোপে ন্যাটোর পূর্বমুখী বিস্তারকে রাশিয়া তার নিরাপত্তার জন্য একটি বিরাট হুমকি হিসেবে দেখেছে।

শত শত বছর ধরে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে এক অম্লমধুর সম্পর্ক বিরাজমান ছিল। পঞ্চাশের দশকে ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূত সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ দুই জাতিসত্তার পুনর্মিলনের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ১৯৫৪ সালে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ান ফেডারেশন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ইউক্রেনের সঙ্গে জুড়ে দেন। এতদসত্ত্বেও ইউক্রেন ও রাশিয়ার জনগণের এক বিরাট অংশের মধ্যে অবিশ্বাসবোধ রয়ে যায়। রাশিয়ার জনগণের এক বিরাট অংশ মনে করে, ইউক্রেন ও বেলারুশ আসলেই মূল রাশিয়ার অংশ। ভদ্মাদিমির পুতিনও বৃহত্তর স্লাভিক রাশিয়ার স্বপ্ন দেখেন।

পূর্ব ইউক্রেনের দোনবাস এলাকা ইতোমধ্যে রাশিয়ার দখলে চলে গেছে। এ অঞ্চলের প্রায় ৩০ শতাংশ জনগোষ্ঠী রাশিয়ান বংশোদ্ভূত। তাই এতদঞ্চলে রাশিয়ার বেশ সমর্থক আছে। এখানকার বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল 'দোনেটস্ক' ও 'লুহানক্স'কে মস্কো ইতোমধ্যে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সেখানে বস্তুতপক্ষে মস্কো-সমর্থিতরাই শাসনকার্য পরিচালনা করছে। ক্রিমিয়া উপদ্বীপ রাশিয়া ২০১৪ সালে দখলে নিয়ে নেয় এবং সেখানে রাশিয়ার পক্ষে 'গণভোট'-এর মাধ্যমে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে ফেলে। ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর মারিউপলের পতনের পর রাশিয়ানরা এখন পূর্ব ইউক্রেনের পুরো উপকূলরেখা নিয়ন্ত্রণ করছে। পুতিনের পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে ইউক্রেনের সর্ববৃহৎ সমুদ্রবন্দর ওডেশা দখল করা। রাশিয়া ওডেশা দখল করতে পারলে ইউক্রেন সম্পূর্ণভাবে স্থলবেষ্টিত দেশ হয়ে যাবে। তখন ইউক্রেনের অর্থনীতি আরও মারাত্মক সংকটে পড়বে।

তবে এটাও সত্য, রাশিয়ার সৈন্যদের পশ্চিমে এগোনো কঠিন হতে পারে। কারণ ইউক্রেনীয়রা ক্রমেই পশ্চিমা অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে রাশিয়ার ওপর অর্পিত বিবিধ নিষেধাজ্ঞা ক্রমেই রাশিয়ার অর্থনীতিকে দুর্বল করছে। মনে রাখা প্রয়োজন, যদিও রাশিয়া সামরিক দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ, কিন্তু এর মোট জিডিপি ফ্রান্স, জার্মানি, এমনকি দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়েও স্বল্প। দেশটি মূলত তেল, গ্যাস ও কৃষিপণ্য রপ্তানি করে এবং পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে শিল্পজাত পণ্য আমদানি করে থাকে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধের ৬০ শতাংশই পশ্চিম ইউরোপ থেকে আমদানি হয়ে থাকে। তাই দেশটির পক্ষে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। রাশিয়ানরা এটাও নিশ্চয় ভুলে যায়নি- পশ্চিমা বিশ্ব বিনা রক্তপাতে শীতল যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল।

ওদিকে ইউক্রেনে হামলা ও দখলের মাধ্যমে রাশিয়ার প্রতিবেশীদের মধ্যে এ বার্তা পৌঁছে গেছে- তারা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিক হুমকির সম্মুখীন। এখন পর্যন্ত নিরপেক্ষ থাকা ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের আবেদন তার একটি উদাহরণ। সুইডেন ঊনবিংশ শতক থেকে নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করেছে এবং ইউরোপের সব যুদ্ধ থেকে তারা নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছে। ১৯৩৯ ও ১৯৪১-৪৪ সালে রাশিয়ার সঙ্গে দুটি যুদ্ধে ফিনল্যান্ড তার ভূমির বেশ কিছু অংশ হারিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তারা একটি অপমানজনক শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হয়। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ ফিনল্যান্ডবাসীর মনে সেই পুরোনো ভীতি নতুন করে জাগ্রত করেছে।

রাশিয়ার ইউক্রেন হামলা বিশ্বের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আস্থাহীনতার জন্ম দিয়েছে। জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে একটি বড় শক্তি যদি তার প্রতিবেশী ছোট দেশগুলোর ওপর হামলা চালিয়ে তার ভূখণ্ড দখল করে নিতে পারে, তাহলে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত রাষ্ট্রব্যবস্থার অস্তিত্বই বিপন্ন হতে বাধ্য। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই যুদ্ধ কভিড-পরবর্তী আরেকটি বিরাট অর্থনৈতিক ধাক্কা। বিশ্ববাজারে রাশিয়া ও ইউক্রেন গম, ভুট্টা ও ভোজ্যতেলের প্রধান রপ্তানিকারক। এই বাণিজ্য প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটায় ইতোমধ্যে আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক দেশে ব্যাপক খাদ্য ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। আফ্রিকার অনেক দেশেই ইতোমধ্যে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে। তেল ও গ্যাসের দর আকাশচুম্বী হওয়ায় অনেক দেশের বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডার নিঃশেষপ্রায়। বিশ্বজুড়ে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর ওপর এই যুদ্ধের চাপ পড়েছে সবচেয়ে বেশি।

১৯৯১ সালে শীতল যুদ্ধের অবসানে নতুন যে বিশ্বব্যবস্থার স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম; যে বিশ্বে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ হবে; পরমাণু অস্ত্রভান্ডার ধীরে ধীরে বিনষ্ট করা হবে; সামরিক ব্যয় কমিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নে অধিক ব্যয় হবে; যেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চর্চা বাড়বে এবং বিশ্বজুড়ে কল্যাণ রাষ্ট্র সংহত হবে- আজ সে স্বপ্ন ভুল প্রমাণিত। শীতল যুদ্ধকালীন বিশ্বের তুলনায় আজকের বিশ্ব অনেক বেশি সংঘাতময়; অনেক বেশি রক্তক্ষয়ী।

বিশ্বের আপামর জনগণ ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের দ্রুত পরিসমাপ্তি কামনা করছে। এ জন্য প্রাথমিক পদক্ষেপ হতে পারে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে যুদ্ধবিরতি; লাখো শরণার্থীকে দ্রুত প্রত্যাবাসন এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আবার চালুকরণ। এটা কেবল যুদ্ধরত দেশগুলোর জন্যই নয় বরং বিশ্বের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমা শক্তিগুলোর উচিত রাশিয়ার সত্যিকার নিরাপত্তা বিষয়ে সজাগ থাকা এবং রাশিয়াকে ঘিরে ফেলা থেকে নিজেদের বিরত রাখা। রাশিয়াকেও আন্তর্জাতিক সীমানার স্বীকৃতি অবশ্যই দিতে হবে এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সমস্যা মেটাতে হবে। আর যুদ্ধ নয়। বিশ্বনেতৃবৃন্দের কাছে আমাদের প্রত্যাশা একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ বিশ্বের জন্য এক হয়ে কাজ করা।

  এয়ার কমডোর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: নিরাপত্তা বিশ্নেষক; গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক, ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, বাংলাদেশ