- মতামত
- গো এষণা
গো এষণা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেন্দ্রগুলোর দুরবস্থার যে চিত্র শনিবার সমকালের এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। প্রতিবেদনমতে, দেশের এ শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ৫৮টি গবেষণা কেন্দ্রের প্রায় সবক'টিই চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তাদের নেই কোনো প্রকাশনা; ইন্টারনেটেও উপস্থিতি না থাকার মতো। কোনো কোনো গবেষণা কেন্দ্রে বহু বছর ধরে পরিচালক না থাকলেও এ নিয়ে কারও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। শুধু তাই নয়, এসব কেন্দ্রের জন্য প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় বাজেটে অল্পস্বল্প হলেও টাকা বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু অনেকে কাজকর্ম নেই বলে সেই টাকা তোলেন না। যাঁরা তোলেন, তাঁদেরও কেউ কেউ সেই টাকা কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের পেছনে খরচ করেন। আসলে গবেষণা কেন্দ্রগুলোর এ স্থবিরতাই বলে দেয়, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে পরিচিত শতবর্ষী এ প্রতিষ্ঠান কেমন চলছে। বলা হতে পারে, এক সময়ে সেশনজটে হাবুডুবু খাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এখন ক্লাস-পরীক্ষা নিয়মিত হয়; শিক্ষার্থীরা সময়মতো ভর্তি হন, আবার ডিগ্রি নিয়ে সময়মতো বেরিয়েও যান। কিন্তু নিয়ম করে পাঠদানই কি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র কাজ? জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি নতুন জ্ঞান সৃজনও তার কাজ। আর নিয়মিত গবেষণা না হলে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হবে কীভাবে? তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় হলো বিশেষায়িত শিক্ষার স্থান; উপযুক্ত গবেষণাকর্ম ছাড়া যা সম্পূর্ণ হতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা এ বিষয়টা জানেন না, তা নয়। তবে তাঁরা যে তাঁদের নির্ধারিত দায়িত্বটুকুও ঠিকভাবে পালন করছেন না, এটুকু আমরা বলতে পারি। কারণ যদি তা না হতো, তাহলে তাঁরা প্রতিবছর গবেষণা কেন্দ্রগুলোর জন্য কিছু অর্থ বরাদ্দ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করতেন না। সে বরাদ্দ উদ্দিষ্ট কাজে খরচ হলো কিনা, তা-ও তদারকি করতেন।
এটা ঠিক, গবেষণা কেন্দ্রগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে যে টাকা বরাদ্দ পায়, তা দিয়ে ভালো মানের গবেষণা পরিচালনা সম্ভব নয়। এটা শুধু আমরা নই, শিক্ষানুরাগী মানুষমাত্রই স্বীকার করেন। এ কারণে শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়টি বহু বছর ধরেই শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবিতে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি খোদ প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা আমরা শুনেছি। তিনি এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রতি উপযুক্ত গবেষণা প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বানও জানিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবেদনে এটা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে- কেন্দ্রগুলোর বেশিরভাগের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকরা আর যা-ই হোক, গবেষণাকাজে কেন্দ্রগুলোকে সচল করতে খুব একটা আগ্রহী নন। এ অবস্থা দেখে কেউ যদি কেন্দ্রগুলোর পরিচালকদের, এমনকি গবেষণার প্রতি আগ্রহ নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন, তাহলে তাঁকে খুব একটা দোষ দেওয়া যাবে না।
এ হতাশাজনক পরিস্থিতি বেশি দিন চলতে পারে না। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে যে গতিতে এগিয়ে চলছে, তাকে টেকসই করতে হলে মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্র ও সমাজকে ২০৪১ সালের মধ্যে একটা উন্নত অবস্থানে নেওয়ার যে স্বপ্ন আমাদের কর্তাব্যক্তিরা দেখছেন, তার জন্যও এটা জরুরি। এ কাজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। একটা সময় ছিল, যখন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা ছাড়াই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, বিশেষ করে বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানে বিশ্বমানের গবেষণা পরিচালনা করেছেন। যে গবেষণার জন্য বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু (এস এন বোস নামে যিনি বেশি পরিচিত) বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে 'ঈশ্বরকণার জনক' বলে আখ্যায়িত হয়েছেন, তা পরিচালিত হয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এক নিভৃত কক্ষে। গত শতকের দ্বিতীয় দশকে সম্পাদিত এ গবেষণার সময় এস এন বোস এখানকার শিক্ষক ছিলেন। আমরা জানি, ওই মানের গবেষণা বর্তমানে উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন ছাড়া সম্ভব নয়। আবার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ছাড়াও এমন আয়োজন কঠিন। কিন্তু এমন গবেষণার জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে প্রবল আগ্রহ তৈরি করা প্রয়োজন, তা করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। গবেষণার সন্ধি বিচ্ছেদ গো যোগ এষণা, যাকে অনেকে হারিয়ে যাওয়া গরু খোঁজার সঙ্গে তুলনা করেন। গরু খোঁজার এ কষ্টের কাজটি বিশ্ববিদ্যালয়কেই করতে হবে।
মন্তব্য করুন